আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন নতুন মেরুকরণ দৃশ্যমান, ঠিক তখনই জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এক দৃঢ় বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এই নির্বাচনকে ‘গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তার দল এবার ‘সংস্কারের পাহারাদার’ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এই ঘোষণা দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এনসিপির এই অবস্থান দেশের সামগ্রিক ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করে, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাদের অঙ্গীকারের প্রতিফলন।
নেতৃত্বের বার্তা ও জুলাই যোদ্ধাদের সম্মাননা
সোমবার রাতে বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে এক বিশেষ দোয়া মাহফিল ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগের পর দেশে ফিরে আসা চব্বিশ জন আন্দোলনকারীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো। এই আবেগঘন পরিবেশে নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যগুলো করেন। প্রবাসে আটক এই সাহসী আন্দোলনকারীদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করে নাহিদ বলেন, সরকারের উচিত ছিল আরও আগে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।’ নাহিদ ইসলাম আরও উল্লেখ করেন, এই মুক্তিপ্রাপ্তদের পুনর্বাসন এবং সম্মানজনক কর্মসংস্থানের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে, যা তাদের আত্মমর্যাদা এবং ভবিষ্যৎ জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। তিনি মনে করেন, যারা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের এই নৈতিক দায়বদ্ধতা পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রবাসীদের ভূমিকা ও ভোটাধিকার
দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরে নাহিদ ইসলাম জানান, এনসিপির দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ভোটের সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতিতে প্রবাসীদের অংশগ্রহণে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং তাদের কণ্ঠস্বরকে আরও শক্তিশালী করবে। তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা জরুরি,’ যা তাদের জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং দেশের উন্নয়নে তাদের অবদানের স্বীকৃতি। এই পদক্ষেপ শুধু ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে না, বরং ভৌগোলিক দূরত্বকে অতিক্রম করে প্রবাসীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে আরও সুদৃঢ় করবে। এটি গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি – সকলের অংশগ্রহণ – কে আরও মজবুত করবে বলে এনসিপি মনে করে।
সংস্কারের পথে বাধা ও গণভোটের চ্যালেঞ্জ
নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে দেশের চলমান সংস্কার কার্যক্রমে পরিকল্পিত বাধার অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে সংস্কারের ধারা শুরু হয়েছিল, তা এখন একটি সুসংগঠিত চক্রের মাধ্যমে ব্যাহত করার চেষ্টা চলছে। তার দাবি, একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে এবং আরেকটি নেপথ্যে থেকে এই সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তিনি এর পেছনে পুরোনো স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন রয়েছে বলে ইঙ্গিত দেন। আসন্ন গণভোট প্রসঙ্গে নাহিদ কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘ফ্যাসিস্টদের অনুসারী ছাড়া কেউ জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ‘না’-এর পক্ষে থাকার কথা নয়।’ তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, একটি নির্দিষ্ট শক্তি পুরোনো কাঠামো ও স্থিতাবস্থা ধরে রাখতে সচেষ্ট, এবং তারা ‘না’-এর পক্ষে প্রচারণা চালাতে পারে। এই বিষয়ে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি, যাতে কোনো অপশক্তি জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে না পারে।
জাতীয় অগ্রগতির লক্ষ্যে এনসিপির অঙ্গীকার
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মনে করেন, দেশের বর্তমান নির্বাচনী রাজনীতি তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে। তার মতে, একটি নির্বাচন হওয়া উচিত নিছক ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, বরং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং একটি সুদৃঢ় ও কার্যকরী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রধান মাধ্যম। তিনি বলেন, এই মৌলিক বিষয়গুলোতেই দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত এবং এগুলিই দেশের প্রকৃত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে। এনসিপি এই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সেই সব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে দেখছে, যা দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং একটি প্রগতিশীল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে। এনসিপি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, জনমুখী সংস্কারের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব।
