শীতের আগমনী বার্তা প্রকৃতিতে স্পষ্ট হলেও, রাজধানীর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে তা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে। সাধারণত এই সময়ে শীতকালীন সবজির প্রাচুর্য দেখা যায়, যা দাম কমিয়ে আনে। তবে এবার পরিস্থিতি অনেকটাই ব্যতিক্রম। শীতের মৌসুম পুরোদমে শুরু হওয়া সত্ত্বেও, বাজারগুলোতে শীতের সবজির সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কম, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দামের উপর। সাধারণ ভোক্তাদের জন্য এটি এক নতুন দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সবজি কিনতে গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
সবজির উচ্চমূল্য: এক অস্বাভাবিক প্রবণতা
বর্তমানে রাজধানীর বাজারগুলোতে অধিকাংশ সবজির মূল্য কেজিপ্রতি ৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, এমনকি কিছু সবজির ক্ষেত্রে তা ১০০ টাকার উপরেও বিকোচ্ছে। এটি এমন একটি প্রবণতা যা শীতকালে সচরাচর দেখা যায় না। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ আয়ের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে এবং বাজেট ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি করছে।
মৌসুমি গতিশীলতা এবং ভোক্তার চাপ
সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুম হিসেবে বিবেচিত। এই সময়ে দেশের বাজারে মাছ, মাংস ও ডিমের মতো প্রাণিজ আমিষের দাম তুলনামূলকভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকে। ফলে ভোক্তাদের একটি বড় অংশ সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে সবজির উপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যার কারণে সবজির সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও দাম চড়া থাকে। শীতকালীন আগাম সবজি সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাজারে আসতে শুরু করলে এই চাপ কমে এবং দামের পারদ নিম্নগামী হয়। তবে এই বছর সেই চিত্রটাই পাল্টে গেছে।
শীতকালীন সবজি আগমনের বিলম্ব: মূল কারণ
তবে এই বছর চিত্রটা ভিন্ন। বিক্রেতাদের মতে, শীতের আগাম সবজি বাজারে আসতে আশাতিরিক্ত বিলম্ব হয়েছে। এই দীর্ঘসূত্রতা বাজারে সবজির উচ্চমূল্যকে দীর্ঘায়িত করেছে। গত কয়েকদিনে অবশ্য ফুলকপি, শিমসহ কিছু আগাম শীতকালীন সবজি বাজারে আসতে শুরু করেছে, যা এসব পণ্যের দামে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত স্বস্তি এনেছে। বিক্রেতারা সাধারণত অক্টোবরের শুরুতেই এই সবজিগুলোর আগমন প্রত্যাশা করেন, কিন্তু এবার তা হয়েছে দেরিতে। এই দেরির কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, এর পেছনে রয়েছে প্রাকৃতিক কারণ এবং কৃষকদের ঝুঁকি এড়ানোর প্রবণতা।
কৃষকদের সংগ্রাম: যশোরের অভিজ্ঞতা
দেশের অন্যতম প্রধান সবজি উৎপাদনকারী অঞ্চল যশোরের চিত্রও এই বিলম্বে সায় দেয়। যশোর সদর উপজেলার নোঙরপুর গ্রামের কৃষক বদরুল আলম, যিনি এ বছর ৪০ শতক জমিতে আগাম মুলা চাষ করেছেন, ইতিমধ্যে ২৫ শতক জমির মুলা বিক্রি করেছেন। তার ভাষ্যমতে, “আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কারণে এবার আগাম সবজি চাষ কিছুটা দেরিতে শুরু হয়েছে, যার ফলস্বরূপ খেত থেকে সবজি তুলতেও বিলম্ব ঘটেছে।” টানা বৃষ্টিপাত ও অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে অনেক কৃষকই সঠিক সময়ে বীজ বপন বা চারা রোপণ করতে পারেননি, যা সার্বিক উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ: টানা বৃষ্টির প্রভাব
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ এই বিলম্বের মূল কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, “এ বছর একটা লম্বা সময় ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টানা বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বৃষ্টির কারণে কৃষকরা আগাম সবজি চাষের ঝুঁকি নিতে পারেননি, কারণ অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও জলাবদ্ধতা ফসলের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে।” অধ্যাপক আহম্মেদের মতে, “এ কারণেই আগাম শীতকালীন সবজি মূলত অক্টোবরের শেষের দিক থেকে বাজারে আসতে শুরু করেছে, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেকটাই দেরি।” এই বিলম্বিত আগমন সরাসরি বাজারে সরবরাহ ঘাটতি এবং উচ্চমূল্যের অন্যতম প্রধান কারণ।
পাইকারি বাজারের বাস্তবতা
বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার এই পরিস্থিতিকে সমর্থন জানিয়ে বলেন যে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কাঁচামাল সরবরাহে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটেছে। তিনি আরও জানান যে, এই বিলম্বিত সরবরাহ চেইন খুচরা বাজারে দামের উপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং ভোক্তাদের জন্য তা আরও কঠিন করে তুলেছে। উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি বাজার পর্যন্ত এই প্রভাব সুস্পষ্ট।
সব মিলিয়ে, শীতের আনুষ্ঠানিক আগমন হলেও শীতের সবজির সহজলভ্যতা ও সাশ্রয়ী মূল্যের জন্য ভোক্তাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে নতুন করে সবজির উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি না পেলে বর্তমান উচ্চমূল্য বজায় থাকার আশঙ্কা রয়েছে, যা দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করবে।
