দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো এর ব্যাংকিং খাত, আর এই খাতের মেরুদণ্ড হলো সুশাসন ও স্বচ্ছতা। যখন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এই মূলনীতিগুলো লঙ্ঘিত হয়, তখন তা কেবল সেই প্রতিষ্ঠানের জন্যই নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি, দেশের অন্যতম শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক পিএলসি (এআইবিএল)-এর শীর্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত গুরুতর অভিযোগগুলো ব্যাংকিং সেক্টরে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি এবং প্রচলিত ব্যাংকিং রীতিনীতি লঙ্ঘনের মতো গুরুতর বিষয়াবলি, যা ব্যাংকটির ভাবমূর্তি ও গ্রাহকদের আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে বিতর্ক ও অভিযোগের সূত্রপাত
ব্যাংকের শীর্ষ পদ, বিশেষত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যেখানে মেধা, অভিজ্ঞতা এবং স্বচ্ছতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক পিএলসি-এর ক্ষেত্রে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে। গত ২ সেপ্টেম্বর, এআইবিএল কর্তৃপক্ষ এমডি ও সিইও পদের জন্য বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এই বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতা হিসেবে ন্যূনতম ১০ থেকে ২০ বছরের সমৃদ্ধ ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার শর্তারোপ করা হয়েছিল, যা এই পদের গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, এই গুরুত্বপূর্ণ পদে মোট ২৪ জন অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যাংকার আবেদন করেছিলেন। প্রত্যাশা ছিল, আবেদনকারীদের মধ্য থেকে একটি নিরপেক্ষ ও আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সেরা প্রার্থীকে নির্বাচন করা হবে, যেখানে তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলী যাচাই করা হবে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার বা ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়নি, যা প্রচলিত নিয়োগ পদ্ধতির চরম লঙ্ঘন। বরং, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্বরত মো. রাফাত উল্লাহ খানকে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের এমডি হিসেবে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গোপনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এই পদক্ষেপটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর সংশয় তৈরি করেছে এবং এর পেছনে বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করেছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নেপথ্যে
ব্যাংকিং পাড়ায় জোর গুঞ্জন চলছে যে, প্রস্তাবিত এমডি মো. রাফাত উল্লাহ খান বর্তমান ব্যাংক চেয়ারম্যান খাজা শাহরিয়ারের শ্যালক। এই কথিত পারিবারিক সম্পর্ক নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর সংশয় তৈরি করেছে এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে। অভিযোগের আঙুল আরও উঠে এসেছে ব্যাংকের আরেক ক্ষমতাধর পরিচালক এবং নির্বাহী কমিটি (ইসি) কমিটির সভাপতি আবদুল ওয়াদুদের দিকে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি এই পুরো প্রক্রিয়ায় চেয়ারম্যানকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন, যা ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। এই ধরনের অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে এটি স্পষ্টতই মেধা ও যোগ্যতাকে উপেক্ষা করে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ব্যাংকের শীর্ষ পদ পূরণের একটি গুরুতর দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
এ ধরনের পদক্ষেপ কেবল ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসনকেই ক্ষুণ্ন করে না, বরং যোগ্য ও মেধাবী কর্মীদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয় এবং ব্যাংকটির সামগ্রিক কর্মপরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে প্রতিষ্ঠানের মনোবল ভেঙে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদে কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাংকটির ভেতরের মহলে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে, যা কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে এবং ব্যাংকের সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার বাধ্যতামূলক শর্ত লঙ্ঘন
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক একটি শরীয়াহভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার প্রতিটি কার্যক্রম ইসলামী শরীয়াহর নীতিমালা মেনে পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক শর্ত হলো, প্রার্থীর অন্তত দুই বছরের ইসলামী ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই শর্তটি ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমের মূল ভিত্তি, অর্থাৎ শরীয়াহ পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি। একজন এমডিকে ইসলামী অর্থনীতির নীতিমালা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতে হয় এবং সে অনুযায়ী ব্যাংকের সকল কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকি করতে হয়।
কিন্তু প্রস্তাবিত এমডি মো. রাফাত উল্লাহ খানের পূর্ববর্তী কর্মজীবনের রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি পূর্বে কখনোই কোনো ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করেননি। এই তথ্য সামনে আসার পর সংশ্লিষ্ট মহলে তীব্র প্রশ্ন উঠেছে: ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মৌলিক অভিজ্ঞতা ছাড়া তিনি কীভাবে একটি শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালনের জন্য বিবেচিত হতে পারেন এবং শরীয়াহ পরিপালন সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে পারবেন? এই গুরুতর অভিযোগ ব্যাংকের শরীয়াহ পর্ষদের ভূমিকা, নিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্ত এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি নিয়েও গভীর প্রশ্ন তৈরি করেছে, যা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নীতিগত ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ করছে।
ভবিষ্যৎ সংকট ও উদ্বেগের আহ্বান
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক পিএলসি-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই গুরুতর অভিযোগগুলো ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং সুশাসনের প্রতি এক বিশাল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এমডি নিয়োগের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি এবং নীতিমালা লঙ্ঘনের ঘটনা কেবল ব্যাংকটির সুনামকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং এর দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা ও গ্রাহকদের আস্থাকেও হুমকির মুখে ফেলবে। এ ধরনের অনিয়ম ব্যাংকের করপোরেট সুশাসনকে দুর্বল করে দেয় এবং বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংকের শরীয়াহ পর্ষদের উচিত দ্রুত এই অভিযোগগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা এবং জনমানুষের আস্থা ধরে রাখার জন্য এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নেওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
