More

    রাশিয়ার তেল কেনা কমিয়েছে ভারতের রিলায়েন্স, ট্রাম্পের শুল্কের চাপ

    ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাগুলোর জটিল জাল যখন বৈশ্বিক জ্বালানি বাণিজ্যকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে, ঠিক তখনই ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ একটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা আংশিকভাবে স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষত, গুজরাট প্রদেশের জামনগরে অবস্থিত তাদের রপ্তানিমুখী তেল পরিশোধনাগারের জন্য রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল কেনা হবে না বলে জানিয়েছে রিলায়েন্স।

    আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব

    রিলায়েন্সের এই সিদ্ধান্তের পেছনে মূলত দুটি প্রধান কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার প্রত্যয়। এই নিষেধাজ্ঞায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তৃতীয় কোনো দেশ হয়ে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা যাবে না। এই বিধি ভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। যদিও এই নিষেধাজ্ঞা ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা, রিলায়েন্স তার আগেই এই নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে নিজেদের দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছে।

    দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। গত শুক্রবার থেকে কার্যকর হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ তেল রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান রজনেফট এবং লুকঅয়েলও অন্তর্ভুক্ত। রিলায়েন্স এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিও সম্মান জানিয়ে রাশিয়ান তেল ক্রয় কার্যক্রম সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে তেমনি বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে উদ্ভূত নতুন বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে।

    রিলায়েন্সের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “২০২৬ সালের ২১ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগেই তার প্রতি মান্যতা দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের বৃহত্তম কর্পোরেশনগুলোর পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার প্রতি তাদের সচেতনতা ও প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত বহন করে।

    আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

    রিলায়েন্সের এই সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্র উষ্ণ স্বাগত জানিয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস অফিস এক বিবৃতিতে এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক আখ্যায়িত করে বলেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য আলোচনাকে অর্থবহভাবে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। এই প্রেক্ষাপটটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিকবার ভারতকে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভারত যদিও তখন আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কার্যত দেখাচ্ছে যে, তারা রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে শুরু করেছে।

    এই সিদ্ধান্তের পেছনে কিছু অর্থনৈতিক কারণও বিদ্যমান থাকতে পারে। সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি প্রায় ৩৭.৫ শতাংশ কমেছে। এই বাণিজ্য ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চাপ সম্ভবত ভারতকে তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে প্রভাবিত করেছে। রাশিয়ার তেল কেনা আংশিকভাবে বন্ধ করার এই পদক্ষেপ কেবল একটি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের একটি জটিল মিশ্রণের ফল। এর মাধ্যমে ভারত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং কূটনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করার ইঙ্গিত দিয়েছে, যেখানে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here