শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, ঝরে পড়া রোধ এবং শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি আর্থিক সহায়তা বিতরণে সম্প্রতি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এখন থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির অর্থ আর কোনো নির্দিষ্ট মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং তা সরাসরি তাদের অভিভাবকদের পছন্দের মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা হবে। এই পদক্ষেপটি সরকারি অর্থ বিতরণে স্বচ্ছতা, সুবিধাভোগীদের স্বাচ্ছন্দ্য এবং ডিজিটাল আর্থিক সেবার ব্যাপক প্রসারে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
উপবৃত্তি বিতরণে নতুন দিগন্ত: একক চুক্তির অবসান ও বহুমুখী প্ল্যাটফর্মের আগমন
দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির সম্পূর্ণ অর্থ কেবল একটি নির্দিষ্ট এমএফএস প্রতিষ্ঠান, নগদ লিমিটেডের হিসাবে যেত। এই এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার কারণে অসংখ্য অভিভাবককে বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট একটি সেবার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হতো, যা অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য অসুবিধাজনক ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সম্প্রতি নগদের সঙ্গে বিদ্যমান একক চুক্তিটি বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে উপবৃত্তি বিতরণে বিকাশ, রকেট, উপায়, এমক্যাশ-এর মতো অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে, উপবৃত্তি বিতরণের মতো একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে দেশের সকল নিবন্ধিত ও অনুমোদিত এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হলো এবং অভিভাবকদের জন্য একাধিক পছন্দের প্ল্যাটফর্ম থেকে সেবা গ্রহণের স্বাধীনতা তৈরি হলো।
অনিয়ম ও অসঙ্গতি: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও চুক্তি বাতিলের কারণ
দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ উদ্যোগ। তবে, পূর্ববর্তী সময়ে এই বৃত্তির অর্থ বিতরণে কিছু গুরুতর অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময় চালু হওয়া নগদ লিমিটেডের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণ বাধ্যতামূলক করার ফলে বড় ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। পরবর্তীতে, সরকারের পতন ঘটলে নগদ লিমিটেডের উদ্যোক্তারা তাদের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান এবং একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি অর্থ বিতরণে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার অংশ হিসেবে উপবৃত্তি বিতরণের পুরোনো পদ্ধতি পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গত ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখের চিঠিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ডাক অধিদপ্তর ও ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদ লিমিটেডের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি বাতিল করা হলো। চুক্তি বাতিলের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি অর্থ বিভাগের নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না এবং নগদ লিমিটেড চুক্তিপত্রের সব শর্ত যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। এই কারণগুলো চুক্তিটি বাতিল করার সিদ্ধান্তকে আরও জোরালো করেছে এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: সুষ্ঠু বিতরণে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা
উপবৃত্তির টাকা বিতরণে একটি সুষ্ঠু, সুচারু ও নির্বিঘ্ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই লক্ষ্য পূরণে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সভায় মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো একটি কার্যকর কৌশল প্রণয়ন করা, যাতে শিক্ষার্থীরা সময় মতো তাদের উপবৃত্তি পায় এবং অভিভাবকদের অর্থ প্রাপ্তি প্রক্রিয়া আরও সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হয়। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার কেবল অর্থ বিতরণ প্রক্রিয়াই আধুনিকীকরণ করছে না, বরং সমগ্র প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি সক্রিয় ও জবাবদিহিমূলক আর্থিক পরিকাঠামো প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
