More

    পরিচালকদের কাজের বছরভিত্তিক মূল্যায়ন করা হবে

    দেশের আর্থিক খাতের সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে সরকার বদ্ধপরিকর। এই লক্ষ্যে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনা পর্ষদের সক্ষমতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন থেকে সরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের বছরভিত্তিক কর্মসম্পাদন (পারফরম্যান্স) নিবিড়ভাবে মূল্যায়ন করা হবে। এটি কেবল একটি মূল্যায়নের বিষয় নয়, বরং তাঁদের দক্ষতা ও কার্যকারিতা আরও শাণিত করার একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়ার অংশ, যা দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করবে।

    এই নতুন ব্যবস্থাপনার আওতায়, নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও পরিচালকবৃন্দকে তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাশাপাশি, তাঁদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কর্মশালারও আয়োজন করা হবে, যা তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও কৌশলগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এই পদক্ষেপগুলো পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করে তুলবে এবং আর্থিক খাতে গতিশীলতা আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।

    পরিচালনা পর্ষদের মেম্বারদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও আনা হয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন। চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের আর্থিক সততা ও নৈতিকতার বিষয়গুলো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যাচাই-বাছাই করা হবে। কেবলমাত্র যাদের আর্থিক স্বচ্ছতা ও নৈতিক মানদণ্ড প্রশ্নাতীত, তারাই এই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য বিবেচিত হবেন। এই কঠোর মানদণ্ড আরোপের মূল উদ্দেশ্য হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুদৃঢ় ভিত্তি নিশ্চিত করা, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।

    নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ও পরিচালকবৃন্দকে প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। তাঁদের ভূমিকা মূলত কৌশলগত নির্দেশনা প্রদান ও নীতি নির্ধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, যা প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এই নিয়ম পরিচালনা পর্ষদের কর্মপরিধিকে আরও সুস্পষ্ট করবে এবং ব্যবস্থাপনার ওপর অযাচিত প্রভাব রোধ করবে। এছাড়া, তাঁদের বয়সসীমা ৪৫ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে নির্ধারিত করা হয়েছে, যা অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি করবে এবং বোর্ডের গতিশীলতা বজায় রাখবে।

    নতুন নীতিমালা ও পূর্ববর্তী সংস্করণের বাতিল

    অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সম্প্রতি এই যুগান্তকারী নীতিমালাটি জারি করেছে। এর পূর্ণাঙ্গ নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের শেয়ার রয়েছে এমন বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান/পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা, ২০২৫’। এই নীতিমালাটি ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল জারি হওয়া এ-সংক্রান্ত পূর্ববর্তী নীতিমালাকে বাতিল করে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারেরই প্রতিফলন এবং একটি আধুনিক ও কার্যকরী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

    আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই নীতিমালার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “পরিচালনা পর্ষদকে অধিকতর দক্ষ ও কার্যকর করে তোলা, তাঁদের পেশাদারিত্ব সুনিশ্চিত করা এবং সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এই চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।” তাঁর এই বক্তব্যে সরকারের সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা দেশের আর্থিক কাঠামোকে আরও মজবুত করবে এবং জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করবে।

    নীতিমালার আওতা ও প্রয়োগ

    এই নতুন নীতিমালাটি দেশের মোট ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং যেসব বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের মালিকানা বা শেয়ার রয়েছে। এই ব্যাপক আওতা আর্থিক খাতের একটি বৃহৎ অংশকে সুশাসনের ছায়াতলে আনবে এবং পরিচালনা পর্ষদের কার্যকারিতা ও জবাবদিহিতাকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করবে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

    দৈনন্দিন কার্যক্রমে অংশগ্রহণে কঠোর নিষেধাজ্ঞা

    পূর্ববর্তী নীতিমালায় চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাঁদের কর্মপরিধি বিষয়ক প্রজ্ঞাপনে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নতুন নীতিমালায় বিষয়টিকে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করে আরও সুদৃঢ় করা হয়েছে। এবারের নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চেয়ারম্যান ও পরিচালকগণ প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যক্রমে কোনোভাবেই অংশ নিতে পারবেন না। এই সুস্পষ্ট সংযোজন পরিচালনা পর্ষদের স্বাধীনতা এবং নির্বাহী ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা বজায় রাখতে অত্যন্ত জরুরি। এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করবে, ব্যক্তিগত প্রভাবমুক্ত একটি পেশাদার কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করবে এবং প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদী সুস্থ কার্যকারিতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়তা করবে।

    এই নতুন নীতিমালা দেশের আর্থিক খাতে একটি শক্তিশালী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এটি পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ব্যক্তিগত সক্ষমতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক কর্মক্ষমতা উন্নত করবে। ফলস্বরূপ, দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হবে। সরকারের এই পদক্ষেপ আর্থিক খাতের দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব ও প্রবৃদ্ধির পথ সুগম করবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here