More

    ‘বিসিএসে কোনো শর্টকাট নেই, লেগে থাকার শক্তিই শেষ পর্যন্ত জিতিয়ে দেয়’

    ৪৪তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে (ইতিহাস) প্রথম স্থান অর্জন করে মাসফিকা রহমান এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার এই অসাধারণ সাফল্য নিঃসন্দেহে বহু আকাঙ্ক্ষিত বিসিএস প্রত্যাশীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনের গল্পটি কেমন ছিল? প্রচলিত ধারণা থেকে ভিন্ন পথে হেঁটে কীভাবে তিনি এই গৌরবময় চূড়ায় আরোহণ করলেন? এসব জানতে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তার প্রস্তুতি, কৌশল এবং সাফল্যের মূলমন্ত্র নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে।

    বিসিএস যাত্রার অপ্রত্যাশিত সূচনা: স্বপ্ন থেকে বাস্তবতার পথে

    সাক্ষাৎকারের শুরুতেই অভিনন্দন জানানোর জবাবে মাসফিকা রহমান বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি জানান, বিসিএস কখনোই তার মূল লক্ষ্য ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়নকালে তার প্রধান স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমানো। এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তিনি স্নাতকের সময় (২০১৫-১৭) আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে কোরিয়ান ভাষাও শিখেছিলেন, যা তার বৈশ্বিক জ্ঞানার্জনের আগ্রহেরই প্রতিচ্ছবি।

    কিন্তু জীবনের অপ্রত্যাশিত মোড়ে ঘটে গেল এক নাটকীয় পরিবর্তন। স্নাতক শেষ হতে না হতেই বিশ্বজুড়ে শুরু হলো করোনাভাইরাস মহামারি। এই বৈশ্বিক সংকট তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাগুলোকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। পারিবারিক চাপ, ক্রমবর্ধমান দায়িত্ববোধ এবং শারীরিক অসুস্থতা—এই সবকিছু মিলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে যায়। ২০২০ সালে তিনি নিজেও করোনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, যা তাকে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তোলে। সেই কঠিন সময়ে তার মনে হয়েছিল, হয়তো কোনো পরিকল্পনাই আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

    ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠার পর, মাসফিকা নতুন করে জীবনের গতিপথ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। পারিপার্শ্বিকতা এবং বাস্তবতা উপলব্ধি করে তিনি দেখেন, পরিবার ও বন্ধুরা তাকে সরকারি চাকরির দিকেই বেশি উৎসাহিত করছেন। বিশেষত, একটি সরকারি চাকরির স্থিতিশীলতা ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। আর এভাবেই তার বিসিএস যাত্রার এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত তাকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিয়েছে।

    পড়াশোনার সময় বণ্টন: নিজস্ব ছন্দে এক সুসংগঠিত প্রস্তুতি

    বিসিএস প্রস্তুতির জন্য একটি কঠোর রুটিন অনুসরণ করা অপরিহার্য—এমন একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও, মাসফিকা রহমানের প্রস্তুতি ছিল অনেকটাই ভিন্ন। তিনি জানান, তার কোনো সুনির্দিষ্ট বা খুব কাঠামোগত রুটিন ছিল না। বরং, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করার পর তিনি যতটুকু সময় পেতেন, পুরোটাই পড়াশোনায় ব্যয় করতেন।

    তার প্রস্তুতির মূল কৌশল ছিল বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। তিনি প্রতিটি বিষয়কে টপিক ধরে ধরে পড়তেন এবং সেগুলোর গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করতেন। অনেকেই যেখানে সময়কে নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ করে পরিকল্পনা করেন, মাসফিকার ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। তার মতে, সময় বণ্টনের চেয়েও বেশি জরুরি ছিল পড়ার মানের উপর জোর দেওয়া। তিনি যা পড়েছেন, তা অত্যন্ত মনোযোগ ও একাগ্রতার সাথে পড়েছেন, যাতে প্রতিটি বিষয় তার মনে গেঁথে যায় এবং ধারণাগত স্বচ্ছতা আসে। এই পদ্ধতি তাকে অপ্রয়োজনীয় চাপ থেকে মুক্তি দিয়ে নিজস্ব ছন্দে প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত তার জন্য ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে।

    বিসিএস প্রস্তুতির বিশেষ কৌশল: শর্টকাট নয়, অবিরাম সাধনাই মূলমন্ত্র

    বিসিএস প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ কৌশল বা শর্টকাটের অস্তিত্ব আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মাসফিকা রহমান একটি অমোঘ সত্য তুলে ধরেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, বিশেষ কোনো শর্টকাট নেই—এটাই সবচেয়ে বড় সত্য। এই পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সফল হতে হলে আপনাকে অবিরাম লেগে থাকতে হবে এবং ধৈর্য ধারণ করতে হবে।

    তার মতে, সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো নিজের হাতে থাকা প্রতিটি মুহূর্তকে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা। সীমিত সময় বা পর্যাপ্ত সময়ের অজুহাত না দিয়ে, যতটুকু সময় আপনার হাতে আছে, তা সঠিকভাবে এবং ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগাতে হবে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি কাজ করে, তা হলো পড়াশোনার ধারাবাহিকতা। একদিন অনেক পড়া এবং পরের দিন একেবারেই না পড়া—এমন বিচ্ছিন্ন প্রস্তুতি কখনোই কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনতে পারে না। বিরামহীন অনুশীলন, নিয়মিত পুনরালোচনা এবং একটি নির্দিষ্ট গতি বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া—এই ধারাবাহিকতাই একজন প্রার্থীকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। মাসফিকার এই কৌশলটি প্রমাণ করে যে, কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই।

    সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি: একাগ্রতা ও সময় ব্যবস্থাপনার সমন্বয়

    সাফল্যের পেছনে কাজ করা সবচেয়ে বড় শক্তি কোনটি—সততা, একাগ্রতা, সময় ব্যবস্থাপনা, নাকি অন্য কিছু—এমন প্রশ্নের উত্তরে মাসফিকা রহমান দুটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তির কথা উল্লেখ করেন: একাগ্রতা ও সময় ব্যবস্থাপনা। এই দুটি গুণ তার বিসিএস যাত্রায় মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

    মাসফিকার মতে, একাগ্রতা বলতে বোঝায় লক্ষ্য স্থির রেখে অবিচল থাকা এবং কোনো প্রকার দ্বিধা বা বিচ্যুতি ছাড়াই সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। বিসিএসের মতো একটি দীর্ঘ ও কঠিন পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় মনকে বিক্ষিপ্ত হতে না দিয়ে প্রতিটি বিষয়ে গভীর মনোনিবেশ করা অত্যন্ত জরুরি। যখন একজন প্রার্থী পূর্ণ একাগ্রতার সাথে পড়াশোনা করেন, তখন তিনি প্রতিটি তথ্য ও ধারণাকে ভালোভাবে আত্মস্থ করতে সক্ষম হন, যা তাকে পরীক্ষার হলে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

    অন্যদিকে, সময় ব্যবস্থাপনা বলতে শুধু একটি রুটিন মেনে চলাকে বোঝায় না, বরং উপলব্ধ সময়কে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করাকে বোঝায়। মাসফিকা রহমানের প্রস্তুতিতে যদিও কাঠামোগত রুটিন ছিল না, তবুও তিনি উপলব্ধ সময়কে অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি মূল্যবান মুহূর্তকে পড়াশোনায় কাজে লাগিয়ে তিনি সিলেবাসের ব্যাপকতা সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন। একাগ্রতার সাথে সঠিক সময় ব্যবস্থাপনার এই সমন্বয়ই মাসফিকা রহমানকে ৪৪তম বিসিএসে প্রথম স্থান অর্জনে সহায়তা করেছে, যা প্রমাণ করে যে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং মানসিক দৃঢ়তা সাফল্যের জন্য অপরিহার্য।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here