More

    বিসিএস ও একাডেমিক পড়াশোনা: সমন্বয়ের জরুরি প্রশ্ন

    জনপ্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার বিসিএস পরীক্ষা এবং এর সিলেবাস সংস্কার নিয়ে অংশীজনদের মধ্যে বর্তমানে নানামুখী আলোচনা চলমান। এই আলোচনা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক, কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়, আমরা যেন সমস্যার মূল শেকড় অনুসন্ধান না করে কেবল উপরিভাগের ডালপালা ছাঁটতে ব্যস্ত। গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত জল ঢালার পরিবর্তে কেবল পাতা সতেজ রাখার এই প্রবণতা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় একটি গভীর সংকট তৈরি করছে। বিশেষত, বিসিএস পরীক্ষার বিদ্যমান সিলেবাসের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।

    বর্তমান বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাস এমনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একাডেমিক বিষয়সমূহ মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত। এর ফলস্বরূপ, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনার্স প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস প্রস্তুতির এক তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। মূল একাডেমিক পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যায়, এবং তারা কেবল বিসিএস সিলেবাসের গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখে। প্রশ্ন উঠেছে, একাডেমিক জ্ঞানের গভীরতা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র বিসিএস-কেন্দ্রিক মুখস্থবিদ্যা দিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোকে কতটা কার্যকরভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব? দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও প্রগতির জন্য এই প্রশ্নটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি।

    বাংলাদেশের কঠিন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক চাকরি পাওয়া বহু মানুষের কাছে বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন। এই প্রেক্ষাপটে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একাডেমিক বিষয় পাশ কাটিয়ে চাকরির পরীক্ষা উপযোগী পড়াশোনাকে গুরুত্ব দেওয়া এক স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই প্রবণতার এক গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিশ্বজুড়ে উচ্চশিক্ষার মান নির্ধারণকারী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন টাইমস হায়ার এডুকেশন (Times Higher Education), তাদের বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যখন আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান নিয়ে সমালোচনা বা বিতর্ক চলে, তখন এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ধরা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন বিসিএস প্রস্তুতির কেন্দ্রে পরিণত হয়, তখন মৌলিক গবেষণা ও গভীর একাডেমিক অধ্যয়ন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, যার প্রতিফলন প্রতি বছরই আমরা আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ের হতাশাজনক ফলাফলে দেখতে পাই।

    এ বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগের জন্ম দেয় যে, যে সকল শিক্ষার্থী এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে অসাধারণ ফলাফল করে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা তালিকায় স্থান করে দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়, তাদের মধ্যেই পরবর্তীতে একাডেমিক বিষয়ে পড়াশোনার আগ্রহ দ্রুত হ্রাস পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের প্রতি তাদের অনীহা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তারা কেবল বিসিএস সিলেবাসের পেছনে ছুটতে থাকে। এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের সুপ্ত মেধা ও সৃজনশীলতা একাডেমিক সীমাবদ্ধতার কারণে বিকশিত হতে না পারলে তা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং রাষ্ট্রের সার্বিক মেধা বিকাশের পথকেও রুদ্ধ করে দেয়। দেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও সুদৃঢ় ও আধুনিক করার জন্য বিসিএস সিলেবাসের আমূল সংস্কার এবং উচ্চশিক্ষায় একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব ফিরিয়ে আনা আজ সময়ের দাবি।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here