মাত্র চার বছরের সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজেকে এক কিংবদন্তী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সালমান শাহ। নব্বইয়ের দশকের এই জনপ্রিয়তম চিত্রনায়ক আজও তাঁর অগণিত ভক্তের হৃদয়ে সমানভাবে ভাস্বর। ছোট পর্দা থেকে মডেলিংয়ের মাধ্যমে তাঁর যাত্রা শুরু হলেও, সিনেমার জগৎ তাকে এক চিরস্থায়ী আসনে বসিয়েছে। সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্র দিয়ে বাংলা সিনেমায় তাঁর অবিস্মরণীয় অভিষেক ঘটে। এই একটি মাত্র ছবিতে অভিনয় করেই তিনি আপামর দর্শকের মনে স্থান করে নেন। মৃত্যুর ২৯ বছর পরও তাঁর জনপ্রিয়তা যেন দিন দিন আরও বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তিনি হয়ে উঠেছেন এক চলমান আলোচনা ও গবেষণার বিষয়।
মাত্র চার বছর দুই মাসে ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে অকালে বিদায় নেওয়া এই তারকা তাঁর প্রথম ছবিটি নিয়েই মুখোমুখি হয়েছিলেন এক ভিন্ন সমালোচনার। তাঁর অভিষেক চলচ্চিত্র ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছিল ভারতের সুপারহিট ছবি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর কপিরাইট থেকে নির্মিত একটি রিমেক। নিজের প্রথম চলচ্চিত্রটি ‘কপি’ হওয়া নিয়ে তাঁকে সেসময় নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর একটি পুরোনো সাক্ষাৎকারের ভিডিও ফেসবুকের বিভিন্ন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট গ্রুপে নতুন করে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি নিজেই এই বিতর্কিত প্রসঙ্গ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন এবং তাঁর অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছিলেন।
বিতর্ক এবং সালমানের ব্যাখ্যা
ভাইরাল হওয়া সেই সাক্ষাৎকারে সালমান শাহ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, “একজন শিল্পীর সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করা উচিত। একজন শিল্পীর সব ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষমতাও থাকা উচিত।” এরপর তিনি নিজেই নিজের প্রথম চলচ্চিত্র রিমেক হওয়ার প্রসঙ্গে ফিরে যান এবং প্রশ্ন তোলেন, “এখন সেখানে প্রশ্ন আসতে পারে, আমি প্রথম সিনেমায় কপিরাইট ফিল্মের হিরো হলাম কেন?” এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে, একজন অভিনেতা হিসেবে তিনি চরিত্র এবং সুযোগকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, চলচ্চিত্রের মৌলিকতা নয়। তার কাছে শিল্পীর বহুমুখী প্রতিভাই ছিল প্রধান বিবেচ্য।
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নির্মাণের নেপথ্য কাহিনি
সালমান শাহর এই ব্যাখ্যাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছিলেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির প্রয়াত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি এক সাক্ষাৎকারে এই ছবির নেপথ্য কাহিনি বর্ণনা করেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সেসময় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড তিনটি জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ‘সনম বেওয়াফা’, ‘দিল’ এবং ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর কপিরাইট সংগ্রহ করে তাঁর কাছে আসে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এর যেকোনো একটির রিমেক করা। কিন্তু এই তিনটি ছবির জন্য উপযুক্ত নায়ক-নায়িকা খুঁজে পাওয়া এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে তারা সম্পূর্ণ নতুন মুখ নিয়ে ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
নায়িকা হিসেবে তৎকালীন নবাগতা মৌসুমীকে নির্বাচন করা হয়। কিন্তু নায়কের সন্ধান তখনও চলছিল। প্রথমে জনপ্রিয় অভিনেতা তৌকীর আহমেদকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি বিনয়ের সঙ্গে তা ফিরিয়ে দেন। এরপর প্রস্তাব যায় আরেক পরিচিত মুখ আদিল হোসেন নোবেল-এর কাছে, তিনিও চলচ্চিত্রটিতে কাজ করতে রাজি হননি। এমন পরিস্থিতিতে যখন প্রযোজনা সংস্থা ও পরিচালক উভয়ই গভীর চিন্তায় মগ্ন, তখনই এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কিংবদন্তী অভিনেতা আলমগীর-এর সাবেক স্ত্রী খোশনুর আলমগীর, একজন তরুণকে প্রস্তাব দেন যাঁর ডাকনাম ছিল ‘ইমন’। সেই ইমনই পরবর্তীতে বাংলা চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত নায়ক সালমান শাহ নামে পরিচিতি লাভ করেন। খোশনুর আলমগীর-এর এই প্রস্তাবনা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, যা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় মাইলফলক হয়ে আছে।
