নেত্রকোনা: বাংলার সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতির এক অনন্যসাধারণ উৎসব ‘কিচ্ছা উৎসব ১৪৩২’ আজ শনিবার নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় বর্ণিল আয়োজনে শুরু হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী কিচ্ছা পালার এই বৃহৎ সমারোহ গ্রাম বাংলার চিরচেনা আবহের সঙ্গে আধুনিক প্রজন্মের এক মেলবন্ধন তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক উদ্যোগটি স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমীদের পাশাপাশি দেশব্যাপী লোকসংস্কৃতির গবেষক ও অনুরাগী মহলে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছে।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন: আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী
কেন্দুয়া উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় সুপরিচিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সর্বস্বর’ যৌথভাবে এই মহৎ উৎসবের আয়োজক। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজ দিনভর কেন্দুয়ার জয়হরি স্প্রাই সরকারি উচ্চবিদ্যালয় খেলার মাঠ মুখরিত হয়ে উঠবে লোকজ সুর, কাহিনি আর অভিনয়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ১৫ জন স্বনামধন্য বয়াতি ও তাঁদের দল এই আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন, যাঁরা তাঁদের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বাংলার মৌখিক ঐতিহ্যের জীবন্ত রূপ তুলে ধরবেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কুদ্দুস বয়াতি, সায়িক সিদ্দিকী, দিলু বয়াতি, অলিউল্লাহ বয়াতি, সবুজ বয়াতি, জসিম বয়াতি, মনসুর বয়াতি, হামিদ বয়াতি, শামীম বয়াতি সহ আরও অনেক গুণী শিল্পী।
কিচ্ছা: শেকড়ের সন্ধান ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, এই উৎসবে উপস্থাপিত হবে লোকজ কাহিনি, পুরাণ, ধর্মবিশ্বাস এবং জনজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় মোড়া বিভিন্ন কিচ্ছা পালা। কিচ্ছা শুধুমাত্র একঘেয়ে গল্প বলা নয়, এটি লোকসংগীত, কাব্য, অভিনয় এবং গভীর জীবনদর্শনের এক শৈল্পিক সংমিশ্রণ। গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ এবং সামাজিক মূল্যবোধের গল্পগাথা এই পালার মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। সুরের মূর্ছনা, চরিত্রের প্রাণবন্ত অভিনয় এবং দর্শকের মগ্নতা—এই উৎসবে কিচ্ছা গানের সেই চিরায়ত আবহকে আবারও ফিরিয়ে আনবে, যা আধুনিক শহুরে জীবন থেকে অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছিল।
আয়োজকেরা মনে করেন, এই কিচ্ছা উৎসব কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি তরুণ প্রজন্মের কাছে নিজেদের শিকড়, ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। বৈশ্বিক সংস্কৃতির প্রভাবে যখন দেশীয় ঐতিহ্যগুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে, তখন এমন আয়োজন নিজেদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখার এক অসাধারণ প্রয়াস। একই সঙ্গে, এটি গবেষক, সংস্কৃতিবিদ ও সাহিত্যমনস্কদের জন্যও একটি অত্যন্ত মূল্যবান ক্ষেত্র, যেখানে তাঁরা সরাসরি বাংলার মৌখিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। এই উৎসব নতুন প্রজন্মের মনে লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলবে এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আয়োজকদের দৃঢ় বিশ্বাস।
দিনব্যাপী আয়োজন: সকাল থেকে সারা রাত
আজ সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে সারা রাতব্যাপী চলবে এই কিচ্ছা উৎসব। কেন্দুয়া জয়হরি স্প্রাই সরকারি উচ্চবিদ্যালয় খেলার মাঠ প্রস্তুত ঐতিহ্যপ্রেমী হাজারো দর্শকের মিলনমেলায় পরিণত হওয়ার জন্য। এই দীর্ঘ আয়োজনে বয়াতিরা তাঁদের সুরের মূর্ছনা ও গল্পের জাদুতে দর্শকদের বিমোহিত করে রাখবেন, যা গ্রামীণ লোকায়ত সংস্কৃতিকে নতুন মাত্রা দেবে। এই উৎসব একদিকে যেমন বিনোদনের খোরাক জোগাবে, তেমনি অন্যদিকে বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার এক সাহসী উদ্যোগ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
