দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে একটি প্রচলিত ধারণা বিদ্যমান যে, নারীকেন্দ্রিক সিনেমার নিজস্ব কোনো বাজার নেই। এমনটাই শোনা যায় যে, নারীকে কেন্দ্র করে নির্মিত চলচ্চিত্র সাধারণ দর্শকের মনে তেমন একটা আবেদন তৈরি করতে পারে না, ফলে বক্স অফিসে এর বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে এই চিরাচরিত ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। গত এক বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর অর্ধেকেরও বেশি সিনেমাতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা গেছে নারীদের! এই সিনেমাগুলো কেবল নারীর সংগ্রাম, জয় ও উদ্যাপনকেই তুলে ধরেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে নারী নির্মাতারা নিজেরাই নারীর অন্তর্দৃষ্টি থেকে গল্প বুনেছেন, যা আঞ্চলিক চলচ্চিত্র জগতে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
বদলে যাওয়া ধারা: গল্প বলার নতুন ভাষা ও শক্তিশালী নির্মাণশৈলী
নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের এই নতুন ধারা কেবল বিষয়বস্তুতেই নয়, বরং নির্মাণশৈলী এবং উপস্থাপনাতেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। একসময় নারীকেন্দ্রিক সিনেমা মানেই ছিল অতিরঞ্জিত মেলোড্রামা, দুঃখ-কষ্ট আর হাহাকারের গ্লানিময় প্রতিচ্ছবি। কিন্তু বর্তমান সময়ের নির্মাতারা সেই পুরোনো ছক ভেঙে বের হয়ে এসেছেন। তাঁরা বাস্তবসম্মত গল্প, সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং পরিশীলিত নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে নারীদের জীবনকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলছেন, যা দর্শককে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে এবং চলচ্চিত্রকে আরও বাস্তবসম্মত করে তুলছে।
এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো শঙ্খ দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘প্রিয় মালতী’, যা সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত। এই সিনেমাটি দেখলে মনে হয় না এটি কোনো কল্পিত গল্প, বরং বাস্তবতার এক নিখুঁত ও নিপুণ প্রতিচ্ছবি। শুধুমাত্র গল্পের গভীরতাই নয়, অভিনয়শৈলী, কারিগরি উৎকর্ষ, সিনেমাটোগ্রাফি এবং সামগ্রিক নির্মাণশৈলীর বিচারেও ‘প্রিয় মালতী’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। এটি যেন নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে, যেখানে গল্প বলার ধরন এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা সমান তালে চলেছে, যা দর্শকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
নারীর মনোজগৎ ও সমাজের প্রতিচ্ছবি: অভিনব উপস্থাপনা
মাকসুদ হোসাইনের ‘সাবা’ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক অনন্য সংযোজন। মা ও মেয়ের মধ্যকার সম্পর্ক, তাদের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন এবং সংঘাতের যে বাস্তবসম্মত ও গভীর চিত্র এ সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে, তা দেশের চলচ্চিত্রে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিল। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ‘সাবা’ গল্প বলার সাহস দেখিয়েছে এবং সব দিক থেকে এটিকে দেশের সাধারণ চলচ্চিত্রের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে থাকা একটি কাজ বললে মোটেই ভুল হবে না। এটি নারীর আত্মিক সম্পর্ক এবং জটিল মনস্তত্ত্বের এক গভীর বিশ্লেষণ যা দর্শককে মুগ্ধ করেছে এবং সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
অন্যদিকে, লীসা গাজীর ‘বাড়ির নাম শাহানা’ চলচ্চিত্রটি নারীর অদম্য সংগ্রাম এবং স্বকীয়তা উদ্যাপনের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। প্রতিকূলতার সমুদ্রে ডুবে না গিয়ে একজন নারী কীভাবে নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে এবং নিজের যোগ্যতম স্থানে পৌঁছানোর জন্য অবিরাম লড়াই করে, সেই যাত্রাই এ চলচ্চিত্রে অত্যন্ত সাবলীলভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটি কেবল নারীদেরই নয়, বরং যেকোনো লিঙ্গের মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগানোর ক্ষমতা রাখে। এটি মানুষের দৃঢ় সংকল্প এবং আত্মবিশ্বাসের এক জীবন্ত দলিল, যা প্রমাণ করে আত্মবিশ্বাস ও অদম্য ইচ্ছা থাকলে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
বিশেষ প্রেক্ষাপটে নারীর গল্প: মানবিকের গভীরতা
করোনাভাইরাস মহামারীর সময়কে কেন্দ্র করে নির্মিত ‘জয়া আর শারমীন’ চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প নিয়ে হাজির হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ যখন ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু সব সামাজিক বিভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়ায়, তখন মানবতাবোধের যে গভীরতা উন্মোচিত হয়, তাই এই সিনেমার মূল উপজীব্য। এই চলচ্চিত্রটি দেখায় যে, সংকটের মুহূর্তে কীভাবে মানুষের পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সব কৃত্রিম প্রাচীর ভেঙে ফেলে। এটি কেবল মহামারীর একটি গল্প নয়, বরং মানব সম্পর্কের গভীরতা ও সংবেদনশীলতার এক শক্তিশালী আখ্যান, যা মানুষের ভেতরের প্রকৃত মানবিকতা তুলে ধরে।
উপরে উল্লিখিত চলচ্চিত্রগুলো ছাড়াও গত এক বছরে আরও অনেক নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, যা এই প্রবণতাকে আরও সুদৃঢ় করেছে। এই সিনেমাগুলো প্রমাণ করছে যে, গুণগত মান, বাস্তবসম্মত চিত্রণ এবং হৃদয়গ্রাহী গল্প বলতে পারলে নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রও বিপুল সংখ্যক দর্শকের মন জয় করতে পারে। এটি কেবল নারী নির্মাতাদের জন্য নয়, বরং সামগ্রিক চলচ্চিত্র শিল্পের জন্যই এক ইতিবাচক দিক, যা ভবিষ্যতে আরও বৈচিত্র্যময় এবং শক্তিশালী গল্প বলার পথ খুলে দেবে এবং চলচ্চিত্রকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
