More

    ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো’—সিডনির মঞ্চে হিমু-রূপার নস্টালজিয়া

    বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক ধ্রুবতারা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ কেবল একটি নাম নন, তিনি এক অনুভূতি, এক অখণ্ড সত্তা। তাঁর সৃষ্ট অসংখ্য চরিত্র, সে হিমু হোক বা মিসির আলি, বাঙালি পাঠকের মনে এক চিরন্তন স্থান করে নিয়েছে। দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর প্রবাসেও তাঁর প্রভাব অক্ষুণ্ণ। সম্প্রতি সিডনির ম্যাকুয়ারি লিংকস গলফ ক্লাবে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁর সেই অমর সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হলো, যেখানে তাঁর সাহিত্যিক মহিমার এক আবেগঘন উদযাপন দেখা গেল।

    ‘পড়ুয়ার আসর’ এর নিপুণ আয়োজনে ‘প্রিয় পদরেখা’ শীর্ষক এই স্মরণানুষ্ঠানটি ছিল কেবল গতানুগতিক আলোচনা সভার ঊর্ধ্বে এক অনন্য আবেগঘন আয়োজন। সিডনির ম্যাকুয়ারি লিংকস গলফ ক্লাব সেদিন পরিণত হয়েছিল এক নস্টালজিক ক্যানভাসে, যেখানে হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসের চেনা আবহ প্রতিটি কোণায় অনুরণিত হচ্ছিল। গদ্য, পদ্য, গান ও নাট্য-আলাপের এক মনোমুগ্ধকর সমন্বয়ে সাজানো এই আসরটি উপস্থিত দর্শকদের মনে গভীর দাগ কাটতে সক্ষম হয়। এটি ছিল হুমায়ূনের চরিত্রদের সঙ্গে পুনরায় দেখা হওয়ার, তাঁর সৃষ্টিকে নতুন করে অনুভব করার এক দুর্লভ সুযোগ, যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

    হিমু ও রূপার পুনর্মঞ্চায়ন: এক অনবদ্য দৃশ্যকল্প

    এই আয়োজনে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়, যা দর্শকদের মুগ্ধ করে তোলে। মঞ্চে আবির্ভূত হন সিডনির বাঙালি কমিউনিটির পরিচিত তরুণ শিল্পী রূপন্তি আকিদ। তাঁর পোশাক ছিল হিমুর চিরচেনা স্বাক্ষররং নীল শাড়িতে মোড়া, হাতে শোভা পাচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী উপন্যাস ‘হিমুর আছে জল’। রূপন্তি, সিডনির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁর নিয়মিত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইতোমধ্যে তরুণ প্রবাসী শিল্পীদের মধ্যে এক বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর সাবলীল অভিনয় এবং মঞ্চে উপস্থিতি বরাবরই প্রশংসিত।

    রূপন্তির ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশের নাট্যজগতের এক প্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত মুখ, অভিনেতা মাজনুন মিজান। তাঁর পরনে ছিল উজ্জ্বল হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, হাতে স্নিগ্ধ ফুল। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন ও টেলিভিশনে তাঁর সরব উপস্থিতি, বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য নাটক, টেলিফিল্ম ও চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি দর্শকের হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী আসন গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করলেও, প্রবাসের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ সিডনির শিল্পমহলে তাঁকে এক সম্মানিত ও পরিচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

    এই বিশেষ নাট্য-আলাপে রূপন্তি রূপার ভূমিকায় এবং মাজনুন মিজান হিমুর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন। তাঁদের প্রতিটি সংলাপ, অভিব্যক্তি এবং চোখের চাহনিতে ফুটে উঠছিল হিমুর অদ্ভুত চালচলন, রূপার শান্ত অথচ দৃঢ় উপস্থিতি এবং তাদের দুজনের মাঝে বিদ্যমান সেই জটিল অথচ অপূর্ব সুন্দর অনুভূতির সম্পর্ক। যেন মঞ্চের আলো-আঁধারে সত্যই ফিরে এসেছিলেন হিমু তাঁর পরিচিত ভঙ্গিমায়, আর তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন রূপা তাঁর চিরচেনা লাবণ্যে। তাঁদের অভিনয় এতই প্রাণবন্ত ছিল যে, মুহূর্তের জন্য দর্শক ভুলে গিয়েছিলেন যে এটি একটি মঞ্চায়ন; মনে হচ্ছিল যেন হুমায়ূনের কল্পনার জগৎ সশরীরে উপস্থিত হয়েছে।

    নাট্য-আলাপ শুরু হতেই সমগ্র মঞ্চ যেন হুমায়ূন আহমেদের গল্পের এক জীবন্ত পাতায় রূপান্তরিত হলো। যখন হিমুর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো সেই অমর প্রশ্ন‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’— এবং তার উত্তরে রূপার নিবিড় জবাব— ‘না, ভালোবাসি না…কারণ, ভালোবাসলে তো প্রাপ্তির বাসনা থাকে। আমি তোমাকে অনুভব করি।’— তখন সমগ্র হলজুড়ে এক গভীর, সম্মোহিত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এই ক’টি বাক্যে যেন হুমায়ূন আহমেদের প্রেমের নিজস্ব দর্শন, আকাঙ্ক্ষা ও উপলব্ধির জটিলতা এক নিমিষেই মূর্ত হয়ে উঠেছিল। এই সংলাপ কেবল দুটি চরিত্রের মধ্যে কথোপকথন ছিল না, এটি ছিল গভীরতর এক মানবীয় অনুভূতির দার্শনিক উন্মোচন, যা উপস্থিত প্রতিটি দর্শককে গভীরভাবে স্পর্শ করে যায়।

    এই ‘প্রিয় পদরেখা’ অনুষ্ঠানটি প্রমাণ করে দিল যে, দূরত্ব যতই বাড়ুক না কেন, হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্ম এবং তাঁর প্রতি পাঠকের ভালোবাসা চিরন্তন ও অমলিন। প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতি চর্চায় এমন আয়োজন নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যা নতুন প্রজন্মের কাছেও হুমায়ূন আহমেদের অনন্য সাহিত্যকর্মকে পৌঁছে দিতে সহায়ক হবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here