দুই বাংলার সংস্কৃতি অঙ্গনে যে ক’জন শিল্পী তাদের অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে নিজেদের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম জয়া আহসান। ঢাকার এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কলকাতার চলচ্চিত্র জগতেও নিরবচ্ছিন্নভাবে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। শুধু পর্দায় নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও জয়া তার অনুরাগী ও ভক্তদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে ভালোবাসেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তিনি ব্যবহার করেন নিজের ভাবনা, অনুভূতি এবং জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলো ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে। সম্প্রতি তার একটি আবেগঘন পোস্ট মন ছুঁয়ে গেছে অসংখ্য মানুষের।
মায়ের স্মৃতির সুতোয় বোনা শাড়িতে জয়া
গত বুধবার (২২ অক্টোবর) সকালে জয়া আহসান তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পাতায় কিছু ছবি পোস্ট করেন, যা মুহূর্তেই নজর কাড়ে সবার। ছবিগুলোতে তাকে দেখা গেছে তার মায়ের বিয়ের শাড়ি পরিহিত অবস্থায়, আর এর সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন সেই শাড়িগুলোকে ঘিরে নিজের গভীর অনুভূতি ও স্মৃতিচারণ। এটি কেবল একটি পোশাক নয়, বরং পারিবারিক ঐতিহ্য, ভালোবাসা আর স্মৃতির এক জীবন্ত দলিল।
পোস্টে জয়া আহসান লিখেছেন, “এই ছবিগুলোতে যে দুটো শাড়ি দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর; আসলে এগুলো আমার মায়ের বিয়ের শাড়ি। একটা বিয়ের, একটা বৌভাতের। বাবা কিনে নিয়ে গেছিলেন কলকাতা থেকেই।” তিনি আরও যোগ করেন, “সোনার সুতোয় কাজ করা এক চিরন্তন রূপকথা, এখনো ঠিক যেন নতুন নতুন বিবাহের গন্ধে ভরপুর।” পঁয়তাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেলেও শাড়ি দুটোর কারুকাজ এবং আবেদন আজও অম্লান, যা অতীতের সোনালি দিনের এক নিরবচ্ছিন্ন প্রতিচ্ছবি। এই শাড়িগুলো যেন কেবল বস্ত্রখণ্ড নয়, বরং একটি প্রেমের উপাখ্যান, এক সুদূর অতীতের অবিস্মরণীয় স্মৃতিচিহ্ন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলেছে পারিবারিক বন্ধনের উষ্ণতা।
কৈশোরের খুনসুটি থেকে অমূল্য সম্পদ
জয়া তার স্মৃতিকাতর লেখায় তুলে ধরেছেন তার এবং তার বোনের শৈশবের মজার কিছু মুহূর্ত। তিনি লেখেন, “এই দুটো শাড়ি নিয়ে সেই কিশোরীবেলা থেকে আমরা দুই বোন কি কাড়াকাড়িটাই না করেছি! বিবাদ হোক বা খুনসুটি যাই বলি না কেন, সেটা হতো কে কোনটা নেবে তাই নিয়ে! আমি বলতাম নীলটা আমার, বোনের পছন্দ ছিল টুকটুকে লালটা!” পছন্দের এই অদলবদল অবশ্য মাঝে মাঝে ঘটত, কিন্তু অবশেষে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই শাড়িগুলো কেবল পছন্দের বিষয় নয়, বরং তাদের কাছে এগুলোর মূল্য অপরিসীম। এগুলো ছিল তাদের পারিবারিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা ভালোবাসার এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে তাদের। এই নিষ্পাপ লড়াইগুলোই তাদের স্মৃতির ভাণ্ডারে যোগ করেছে এক মিষ্টি অধ্যায়, যা সময়ের সাথে সাথে আরও মধুর হয়ে উঠেছে।
স্মৃতি সংরক্ষণের এক অনবদ্য দর্শন
জয়া আহসানের লেখায় একটি গভীর দার্শনিক মনোভাবও প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি মৌসুমি ভৌমিকের গানের সেই মর্মস্পর্শী লাইনটি উদ্ধৃত করেছেন, “কিছু ফেলতে পারি না আমার হয়েছে সেই অবস্থা।” এই উক্তিটি যেন তার সমগ্র জীবনদর্শনের এক প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, “সব কিছুর ওপরেই স্নেহ, একটা অদ্ভুত মায়া।” বস্তুকে কেবল বস্তু হিসেবে না দেখে, তার পেছনে থাকা গল্প, স্মৃতি এবং আবেগকেই তিনি বেশি প্রাধান্য দেন। তার কাছে মায়ের যত পুরাতন শাড়ি, মায়ের বিয়ের শাড়ি, এমনকি তার জন্মের আগে মায়ের স্বাদ ভক্ষণের শাড়ি—সবকিছুই পরম যত্নে সংরক্ষিত। প্রতিটি তন্তুতে, প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে আছে এক একটি ইতিহাস, এক একটি গল্প। এগুলো কেবল কাপড় নয়, বরং তার মায়ের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের জীবন্ত সাক্ষী।
এই শাড়িগুলো সযত্নে রাখা আছে তার আলমারিতে, “ন্যাপথলিনের রূপকথায় আত্মকথার ইতিহাস।” জয়া একে বর্ণনা করেছেন তার মাতৃতান্ত্রিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হিসেবে। এ যেন কেবল অতীতকে ধরে রাখা নয়, বরং মায়ের প্রতি, মাতৃত্বের প্রতি এবং নিজের পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন। প্রতিটি শাড়ি যেন এক একটি নীরব কবিতা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলেছে নারীর জীবনের বিভিন্ন পর্যায় এবং সংস্কৃতির এক অনবদ্য ধারা।
স্মৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার
দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে রাখা সেই অমূল্য শাড়ি দুটো পরার সুযোগ হুট করেই এসে যায় জয়া আহসানের জীবনে। এই বিশেষ মুহূর্তটিকে তিনি স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি লেখেন, “এবার হঠাৎ করেই সুযোগ হলো এই দুটো শাড়ি পড়ার…সুন্দর করে স্টাইলিং করে ছবিগুলো তুললাম…” এই ছবিগুলো কেবল তার মায়ের শাড়ি পরা কয়েকটি স্থিরচিত্র নয়, বরং বর্তমানের সঙ্গে অতীতের এক চমৎকার মেলবন্ধন। জয়া আহসানের এই পোস্টটি প্রমাণ করে যে, কিছু ঐতিহ্য এবং স্মৃতি কখনোই পুরাতন হয় না, বরং সময়ের সাথে সাথে সেগুলোর গুরুত্ব ও মাধুর্য আরও বৃদ্ধি পায়। এই ধরনের ব্যক্তিগত অথচ সার্বজনীন আবেগঘন পোস্ট ভক্তদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দেয়, কারণ এর মাধ্যমে তারা তাদের প্রিয় তারকার মানবিক ও সংবেদনশীল দিকটি দেখতে পান।
