বলিউডের ঝলমলে দুনিয়ায় কিছু তারকা তাদের আলো দিয়ে দশকের পর দশক ধরে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখেন। এমনই একজন কিংবদন্তী অভিনেত্রী হলেন রাবিনা ট্যান্ডন, যিনি নব্বই দশকের পর্দায় প্রাণবন্ত উপস্থিতি দিয়ে শুরু করে আজ অবধি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ২৬শে অক্টোবর এই অসামান্যা অভিনেত্রীর শুভ জন্মদিন, যিনি তার অভিনয় প্রতিভা, সাহসী সিদ্ধান্ত এবং অটুট আভিজাত্য দিয়ে দর্শক হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।
প্রারম্ভিক জীবন ও নামকরণ
১৯৭২ সালের ২৬শে অক্টোবর মুম্বাইয়ের এক সম্ভ্রান্ত চলচ্চিত্র পরিবারে তার জন্ম। চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক রবি ট্যান্ডন এবং বীণা ট্যান্ডন-এর কন্যা হিসেবে, সিনেমার প্রতি তার অনুরাগ হয়তো রক্তেই মিশে ছিল। তার নামকরণেই রয়েছে এক বিশেষ সার্থকতা; বাবা রবি এবং মা বীণার নামের সার্থক সংমিশ্রণে ‘রাবিনা’ নামটি যেন তার পারিবারিক ঐতিহ্যেরই প্রতিচ্ছবি। পরিবারের ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি আদর করে ‘মুনমুন’ নামেই পরিচিত ছিলেন, যা তার ব্যক্তিগত জীবনের এক ভিন্ন পরিচয় তুলে ধরে।
অভিনয় জগতে পদার্পণ ও শিক্ষা
অভিনয়ের ঝলমলে জগতে পা রাখার আগে রাবিনা একটি জনসংযোগ ও বিজ্ঞাপন সংস্থায় সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে পেশাদার জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই অভিজ্ঞতা হয়তো তাকে জনমানসে নিজেকে তুলে ধরার কৌশল বুঝতে সাহায্য করেছিল। মুম্বাইয়ের ঐতিহ্যবাহী মিথিবাই কলেজে ভর্তি হলেও, উচ্চশিক্ষার দ্বিতীয় বর্ষেই তিনি চলচ্চিত্র জগতে নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার এই একাগ্রতা তার প্রতিভারই পরিচায়ক এবং তার ক্যারিয়ারের প্রতি তার গভীর নিবেদন প্রকাশ করে।
ব্যক্তিগত জীবনের সাহসী পদক্ষেপ
রাবিনা ট্যান্ডনের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল সমাজের প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মতো। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি একক মা হিসেবে দুই কন্যা সন্তানকে দত্তক নিয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকের সমাজে এই ধরনের পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত বিরল এবং সাহসী। তার এই সিদ্ধান্ত কেবল নিজের জীবনের জন্য একটি ব্যক্তিগত নির্বাচনই ছিল না, বরং অনেক নারীর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে তিনি এক নতুন সামাজিক ধারা তৈরি করেছিলেন। মাতৃত্বের এই অসামান্য রূপ তাকে কেবল একজন অভিনেত্রী নয়, একজন দৃঢ়চেতা ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা তার ব্যক্তিত্বে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।
বলিউডে অভিষেক ও তারকা খ্যাতি
বলিউডে রাবিনার আগমন ছিল এক ঝলকানি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাথর কে ফুল’ ছবিতে সুপারস্টার সালমান খান-এর বিপরীতে তার অভিষেক ঘটে। এই সিনেমাটি বক্স অফিসে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে এবং রাবিনা তার প্রথম ছবিতেই ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ নবাগত অভিনেত্রী পুরস্কার লাভ করেন। তার সহজাত অভিনয় প্রতিভা, সাবলীল নাচ এবং প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব তাকে দ্রুতই দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে দেয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় এবং আকাঙ্ক্ষিত তারকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন, একের পর এক হিট ছবিতে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেন এবং নিজের জন্য এক শক্তিশালী তারকাখ্যাতি তৈরি করেন।
কর্মজীবনের বিবর্তন ও আর্থিক সাফল্য
সময়ের সাথে সাথে রাবিনা তার অভিনয় প্রতিভার বিবর্তন ঘটিয়েছেন এবং নিজেকে নতুন প্রজন্মের কাছেও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম এবং দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ ‘আরণ্যক’ (২০২১)-এ তার শক্তিশালী অভিনয় তাকে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। এর পরপরই প্রশান্ত নীলের ব্লকবাস্টার দক্ষিণি ছবি ‘কেজিএফ: চ্যাপ্টার ২’ (২০২২)-এ এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তার উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, তার অভিনয় ক্ষমতা আজও অটুট এবং তিনি যেকোনো ধরনের চরিত্রে নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম।
অভিনয় জীবনের পাশাপাশি রাবিনা ট্যান্ডনের আর্থিক সাফল্যও ঈর্ষণীয়। জিকিউ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৬৬ কোটি রুপি। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৩০ কোটি টাকারও বেশি (তথা ২৩১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৭ হাজার ৩০০ টাকা)। সিনেমা, ওটিটি প্রজেক্ট, বিভিন্ন নামীদামী ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনচিত্র এবং টেলিভিশন শো থেকে আসে তার আয়ের সিংহভাগ। জানা যায়, প্রতি সিনেমার জন্য তিনি প্রায় ২-৩ কোটি রুপি পারিশ্রমিক নেন এবং প্রতিটি বিজ্ঞাপনের জন্য তার ফি প্রায় ৫০ লাখ রুপি। সব মিলিয়ে, তার বাৎসরিক আয় আনুমানিক ২০ কোটি রুপি, যা বলিউডে তার শক্তিশালী অবস্থান এবং বাণিজ্যিক মূল্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
ব্যক্তিগত জীবনেও রাবিনা ট্যান্ডন এক স্থিতিশীল জীবনযাপন করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিবেশক অনিল থাডানিকে বিয়ে করেন এবং বর্তমানে তাদের দুইটি সন্তান রয়েছে। রাবিনা ট্যান্ডন শুধু একজন সফল অভিনেত্রীই নন, তিনি এক অদম্য নারী যিনি তার জীবন ও কর্ম দিয়ে অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন।
