More

    ট্রাভেল এজেন্সির মালিকানা হবে দেশীয়, বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা

    দেশের ট্রাভেল এজেন্সি খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোতে একটি আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ঘোষিত খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা পরিচালনার জন্য এখন শতভাগ দেশীয় মালিকানা আবশ্যক হবে। এই যুগান্তকারী শর্তারোপ দেশের পর্যটন শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, একইসাথে বিদ্যমান কিছু বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের জন্য বয়ে আনতে পারে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।

    নতুন নীতিমালার মূল দিক: শতভাগ দেশীয় মালিকানা

    বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত খসড়া নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনায় বিদেশী বিনিয়োগের আর কোনো সুযোগ থাকবে না; সকল মালিকানা হতে হবে সম্পূর্ণরূপে দেশীয়। এই নীতিগত পরিবর্তন বাংলাদেশ ট্রাভেল এজেন্সি (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ এবং এর সংশোধনী আইন ২০২১-কে পুনঃসংশোধন করার বৃহত্তর সিদ্ধান্তের অংশ। এর প্রধান লক্ষ্য হলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গ্রাহক হয়রানি রোধ করা এবং দেশের আকাশপথে ভ্রমণ সেবায় সুশাসন নিশ্চিত করা। এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি ইতিমধ্যেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সভা সম্পন্ন করেছে, যেখানে অংশীজনদের মতামত এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর আইন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এরই ফলস্বরূপ, ‘বাংলাদেশ ট্রাভেল এজেন্সি (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এটি বর্তমানে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সর্বসাধারণের মতামতের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, যেখানে সাত দিনের মধ্যে মতামত জমা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

    প্রস্তাবিত নীতির দ্বিমুখী প্রভাব: আলোচনা ও সমালোচনা

    এই নতুন শর্তারোপ দেশের ট্রাভেল এজেন্সি খাতে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করছেন যে, এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে দেশের অন্যতম দুটি বৃহৎ অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি প্রতিষ্ঠান, গোযায়ান এবং শেয়ারট্রিপ, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এবং তাদের ব্যবসায়িক মডেল এই নতুন শর্তের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। ফলস্বরূপ, তাদের হয়তো নিজেদের মালিকানা কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে অথবা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হতে পারে।

    অন্যদিকে, এই নীতিমালার সম্ভাব্য ইতিবাচক দিক নিয়েও আলোচনা চলছে। খাতসংশ্লিষ্ট আরেকটি অংশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এই নীতিমালা দেশীয় মালিকানায় পরিচালিত ট্রাভেল এজেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিকশিত হওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি করবে। এটি স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে, পুঁজি দেশেই থাকবে এবং দেশের অভ্যন্তরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। দেশীয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো আরও শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের পর্যটন শিল্পের ভিত্তি মজবুত করবে।

    পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্য: গ্রাহক সুরক্ষা ও সুশাসন

    পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে, এই নীতিগত পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য হলো গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং ভ্রমণ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। বিগত সময়ে অনলাইন ট্রাভেল প্ল্যাটফর্মগুলোতে গ্রাহক হয়রানির বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে, যা মন্ত্রণালয়ের নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। আকাশপথে ভ্রমণের টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে অন্যান্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং গ্রাহকদের জন্য একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পরিবেশ তৈরি করাই এই নতুন অধ্যাদেশের অন্যতম লক্ষ্য। প্রতিবেশী দেশগুলোর সফল মডেল বিশ্লেষণ করে এবং স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সাথে নিবিড় আলোচনার মাধ্যমে এই খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, যা দেশের পর্যটন খাতকে একটি নতুন কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

    বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও পূর্বের বাজার পরিস্থিতি

    তবে, এই খাতের বিদেশি বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট এবং তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্প তার সূচনা থেকেই ছিল অত্যন্ত অনিয়ন্ত্রিত এবং অসংগঠিত। এই পরিবেশে, স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলোই মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের বিরুদ্ধে মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতার অভাব, অতিরিক্ত কমিশন আদায় এবং ভোক্তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগ রয়েছে। অনেক এজেন্সি অস্বচ্ছ কমিশন ব্যবস্থা এবং মধ্যস্বত্বভোগী নেটওয়ার্কের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল ছিল, যা শেষ পর্যন্ত একটি সিন্ডিকেট-নির্ভর বাজার তৈরি করেছিল। এর ফলে সাধারণ গ্রাহকেরা প্রায়শই উচ্চ মূল্য এবং নিম্নমানের সেবার শিকার হতেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দাবি করেন যে, তাদের আগমনের ফলে বাজারে কিছুটা স্বচ্ছতা আসে এবং গ্রাহকরা আরও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ পান। তাদের মতে, এই নতুন নীতিমালা এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোর গতিকে ব্যাহত করতে পারে এবং আবারও বাজারকে পুরনো, অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here