বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যখন নব-উন্মোচিত গাড়িগুলোর মধ্যে ২০ শতাংশেরও বেশি বৈদ্যুতিক যান (ইভি) জায়গা করে নিচ্ছে এবং এর জনপ্রিয়তা ক্রমশ আকাশচুম্বী হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে এর প্রচলন তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে এগোচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী এই পরিবহন ব্যবস্থা দেশের সড়ক পথে ব্যাপকতা লাভ করুক, সেই লক্ষ্যেই শিল্প মন্ত্রণালয় একটি যুগোপযোগী নতুন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই নীতিমালার খসড়া ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে বৈদ্যুতিক গাড়িকে দেশের বাজারে আরও সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করার জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো, একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ কমানো, তেমনই অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে টেকসই পরিবহন ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া।
বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রচলনে নতুন নীতিমালা: একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ
শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তাবিত এই নীতিমালায় বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে আমদানি শুল্ক ও নিবন্ধন ফি কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়াও, ইভি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাবও রাখা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার পথকে সুগম করবে। গাড়ি ব্যবসায়ীদের অভিমত, নীতিমালার এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে, যা গ্রাহকদের মধ্যে এর চাহিদা তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এটি কেবল ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রেই নয়, বরং বাণিজ্যিক পরিবহনের ক্ষেত্রেও ইভির ব্যবহার বাড়াতে উৎসাহিত করবে, যার সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুবিধা রয়েছে।
আর্থিক প্রণোদনা ও শুল্ক হ্রাস: দাম কমানোর কৌশল
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, সম্পূর্ণ প্রস্তুতকৃত বৈদ্যুতিক গাড়ি (Completely Built Unit – CBU) আমদানির ক্ষেত্রে ৮৯.০৮ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য হয়। প্রস্তাবিত নীতিমালায় এই শুল্কের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে ৩৭ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এই বিপুল শুল্ক হ্রাস প্রত্যক্ষভাবে গাড়ির খুচরা মূল্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একই সাথে, দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি সংযোজনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা স্থানীয় সংযোজন শিল্পকে শক্তিশালী করবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এই সমন্বিত শুল্ক কাঠামো বৈদ্যুতিক গাড়ির সামগ্রিক উৎপাদন ও আমদানি খরচ কমিয়ে এটিকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
শিল্প খাতের প্রত্যাশা ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা
গাড়ি ব্যবসায়ীরা এই নীতিমালার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও কিছু নির্দিষ্ট বিষয় স্পষ্ট করার দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ঋণ সুবিধার পাশাপাশি নগদ প্রণোদনা (Cash Incentive) প্রদানের ব্যবস্থা থাকা উচিত। এটি প্রাথমিক বিনিয়োগের বোঝা কমাতে সাহায্য করবে এবং ভোক্তাদের ইভি গ্রহণে আরও উৎসাহিত করবে। এছাড়াও, নীতিমালায় ‘বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদক’ এবং ‘সংযোজনকারী’ এই দুটি সংজ্ঞার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই স্পষ্টতা শিল্পে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি স্বচ্ছ কাঠামো তৈরি করবে।
ব্যবসায়ীরা আরও মনে করেন, যদি বৈদ্যুতিক গাড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদান করা হয়, তবে আন্তর্জাতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবে। এটি কেবল বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণই করবে না, বরং স্থানীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির হস্তান্তরেও সহায়তা করবে। স্বল্প সময়ের জন্য ইভি আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট (VAT) এবং সম্পূরক শুল্ক (Supplementary Duty) প্রত্যাহার করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে, যা ইভির প্রাথমিক বাজার তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ধরনের প্রণোদনাগুলো একটি শক্তিশালী ইভি ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে অপরিহার্য।
পরিবেশ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য
প্রস্তাবিত নীতিমালার খসড়ায় পরিবহন খাতের কার্বন নিঃসরণ কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর দেশের নির্ভরতা হ্রাস করা এবং একটি পরিচ্ছন্ন ও টেকসই চলাচল ব্যবস্থা গড়ে তোলার রূপরেখা বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি কেবল পরিবেশগত দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং জ্বালানি আমদানি বাবদ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমাতেও সহায়ক হবে। এর পাশাপাশি, বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে ইভি উৎপাদনের খরচ কমাবে এবং এ খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে। এই সমন্বিত উদ্যোগগুলো দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং একটি সবুজ ভবিষ্যতের দিকে পথ দেখাবে।
তদারকি ও শিল্প উন্নয়ন: ইভি কাউন্সিলের ভূমিকা
নীতিমালার সুষ্ঠু ও কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে ৩২ সদস্যবিশিষ্ট ‘ইলেকট্রিক ভেহিকেল শিল্প উন্নয়ন কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই কাউন্সিল নীতিমালার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে, প্রয়োজনে নতুন সুপারিশ প্রদান করবে এবং ইভি শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নে দিকনির্দেশনা দেবে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত এই কাউন্সিল বৈদ্যুতিক যান শিল্পের বিকাশকে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসবে, যা দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। এই কাউন্সিল ইভি সংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
