বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এক নতুন মাইলফলক হিসেবে যুক্তরাজ্য ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের জন্য তাদের বাজারে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বহাল রাখার ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ট্রেডিং স্কিম (ডিসিটিএস) কর্মসূচির আওতায় এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে আরও শক্তিশালী করবে এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রক্রিয়াকে সুগম করবে। এটি বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্য অংশীদারিত্বে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
দীর্ঘমেয়াদী শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার: বাংলাদেশের জন্য এক নতুন দিগন্ত
গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ঢাকার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসে। বৈঠকে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশবিষয়ক বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই ফলপ্রসূ আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও গভীর ও সম্প্রসারিত করার কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়, যেখানে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়টি কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিল। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পণ্যকে ব্রিটিশ বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণে সহায়তা করবে।
বাণিজ্যিক সংলাপ: শক্তিশালী অংশীদারিত্বের অঙ্গীকার
ব্যারোনেস উইন্টারটন তার বক্তব্যে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নিবিড় সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার।’ তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বহাল রাখার মূল উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করবে, সেই সন্ধিক্ষণেও যেন তার রপ্তানি খাত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধিতে একটি শক্তিশালী সমর্থন জোগাবে, যা হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখবে।
যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত আরও দৃঢ়ভাবে জানান যে, উভয় দেশের মধ্যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের দিগন্ত প্রসারিত করাই তাদের মূল লক্ষ্য। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় খাতে যুক্তরাজ্যের গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অবকাঠামো খাত, সবুজ জ্বালানি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং শিক্ষা খাতে নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে যুক্তরাজ্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বিনিয়োগগুলো কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই আনবে না, বরং জ্ঞান ও প্রযুক্তি হস্তান্তরেও সহায়তা করবে।
উন্নয়নশীল দেশের পথে বাংলাদেশ: যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা
বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এই উদ্যোগকে উষ্ণ স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হবে, সেটি হবে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সুযোগগুলোকে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাতে যুক্তরাজ্যের মতো একটি উন্নত দেশের সহযোগিতা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি আমাদের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং নতুন বাজার প্রসারে সহায়ক হবে।’ তিনি দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্বের ওপর জোর দেন, যা পারস্পরিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।
বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজের অগ্রগতি এবং এর দ্রুত চালুকরণের বিষয়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘সরকার এই অত্যাধুনিক টার্মিনালটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’ এই টার্মিনাল বাংলাদেশের বিমান যোগাযোগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করতে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এবং পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আলোচনাকালে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) মো. আব্দুর রহমান সহ উভয় দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকটি বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্কের গভীরতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
