দেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহে অন্যতম চালিকাশক্তি এবং ব্যবসায়ী সমাজের কেন্দ্রীয় কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) বর্তমানে এক গভীর ও নজিরবিহীন নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। প্রায় দেড় মাস ধরে দেশের শীর্ষ এই বাণিজ্য সংগঠনটি কার্যত অভিভাবকশূন্য অবস্থায় রয়েছে, যা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়াসহ সামগ্রিক কার্যক্রমে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে। এই অচলাবস্থা শুধু অভ্যন্তরীন সংকট নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
নেতৃত্বের শূন্যতা ও তার প্রভাব
দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বহীনতার এই পরিস্থিতি এফবিসিসিআই’র স্বাভাবিক কার্যক্রমে মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদান এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংগঠনটি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলস্বরূপ, ব্যবসায়ী সমাজ তাদের দাবী ও সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে তুলে ধরার জন্য একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্মের অভাব বোধ করছে, যা বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের সক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে। এর পাশাপাশি, এফবিসিসিআই’র পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ঘিরেও এক চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, যা ভবিষ্যতের নেতৃত্ব এবং সংগঠনের কার্যকারিতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিশ্চয়তা
সংগঠনের অভ্যন্তরে এই অস্থিতিশীলতার সরাসরি শিকার হচ্ছেন এফবিসিসিআই’র প্রায় ৮০ জন স্থায়ী কর্মকর্তা, স্টাফ এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিযুক্ত কর্মীরা। ‘সিগনেটরি পাওয়ার’ বা স্বাক্ষর করার ক্ষমতার অভাবে গত শনিবার পর্যন্ত তাদের সেপ্টেম্বর মাসের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এই দীর্ঘসূত্রতা কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা এবং আর্থিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। এটি দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনের ভাবমূর্তিকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করছে এবং কর্মপরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকেও সতর্ক করছে।
ঘটনার পরম্পরা ও সময়কাল
এফবিসিসিআই’র বর্তমান সংকটের সূত্রপাত গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে, যখন তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পূর্ববর্তী পরিচালনা পর্ষদ বাতিল ঘোষণা করে। এরপর, একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার মূল দায়িত্ব ছিল ১২০ দিনের মধ্যে একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত পর্ষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তবে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবং একাধিকবার মেয়াদ বৃদ্ধির পরও প্রশাসক হিসেবে হাফিজুর রহমানের দায়িত্ব গত ১০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে যায়।
এর পূর্বে, চলতি বছরের জুনের মাঝামাঝি সময়ে এফবিসিসিআই নির্বাচন বোর্ড পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেছিল, যেখানে গত ৭ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের সময়সীমা আরও ৪৫ দিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়। এই ধারাবাহিক ঘটনাবলী সংগঠনের নেতৃত্ব সংকটকে আরও গভীর করেছে। বর্তমানে, প্রশাসকের অবর্তমানে সংগঠনটির দাপ্তরিক কার্যক্রমগুলো এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব আলমগীর তত্ত্বাবধান করছেন, তবে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ারের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ব্যাহত হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের মন্তব্য এই অচলাবস্থার গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যুগান্তরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এফবিসিসিআই’র পরিচালনা পর্ষদ গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে সরকার এই সংকট সমাধানে সচেষ্ট রয়েছে। তবে, সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ এবং সময়সীমা সম্পর্কে এখনো কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি, যা ব্যবসায়ী মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
জাতীয় অর্থনীতিতে এফবিসিসিআইয়ের অনস্বীকার্য গুরুত্ব বিবেচনা করে, দ্রুত একটি স্থিতিশীল ও নির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা এখন সময়ের দাবি। এই দীর্ঘমেয়াদী নেতৃত্বশূন্যতা দেশের বাণিজ্য পরিবেশকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করার আগেই একটি কার্যকর এবং টেকসই সমাধান অনস্বীকার্য। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন ব্যবসায়ী সমাজের আস্থা ফিরে আসবে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও এফবিসিসিআই তার কাঙ্ক্ষিত এবং অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
