মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল সম্প্রতি এক যুগান্তকারী অর্থনৈতিক মাইলফলক অর্জন করেছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এই কোম্পানিটি বাজার মূলধনে চার ট্রিলিয়ন ডলারের এক অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করেছে, যা তাদের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান প্রভাবের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গত মঙ্গলবার এই নজিরবিহীন সাফল্য অর্জিত হয়, যা প্রযুক্তি খাতের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
বাজার মূলধনে একচেটিয়া প্রতিযোগিতা: অ্যাপল, এনভিডিয়া ও মাইক্রোসফট
বর্তমানে বৈশ্বিক বাজার মূলধনের দিক থেকে অ্যাপলের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে মাত্র দুটি প্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানি: এনভিডিয়া এবং মাইক্রোসফট। এই দুটি প্রতিষ্ঠানও চলতি বছরের শুরুতেই চার লাখ কোটি ডলারের বাজার মূলধন স্পর্শ করেছিল। এনভিডিয়া মূলত গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট (GPU) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) চিপে তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে, আর মাইক্রোসফট ক্লাউড কম্পিউটিং এবং সফটওয়্যার সেবায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। এই তিন বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে স্পষ্ট করে তোলে। সৌদি আরবের আরামকো এবং তাইওয়ানের টিএমএসসি বাদে শীর্ষ দশের বাকি আটটি প্রতিষ্ঠানই যুক্তরাষ্ট্রের।
বাজার মূলধনের চালিকাশক্তি: শেয়ারের মূল্য ও তার প্রভাব
একটি কোম্পানির বাজার মূলধন মূলত তার শেয়ারের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। এই বিষয়টি অত্যন্ত গতিশীল এবং নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপলের শেয়ারের দাম কমে যাওয়ায় গত বুধবার কোম্পানিটির বাজার মূলধন সাময়িকভাবে চার লাখ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসে। তবে, এই সাময়িক ওঠানামা সত্ত্বেও, শীর্ষ তিনের মধ্যে অ্যাপলের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকে, যা তাদের শক্তিশালী বাজার ভিত্তি এবং বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদী আস্থার প্রতিফলন।
শেয়ার মূল্য বৃদ্ধি এবং আইফোন ১৭-এর সাফল্য
গত মঙ্গলবার ওয়ালস্ট্রিটে অ্যাপলের শেয়ারের মূল্য শূন্য দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও, এমন বৃহৎ কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। এই বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ কাজ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আইফোন ১৭ মডেলের নতুন ফোনের বিক্রি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়া। অত্যাধুনিক ফিচার এবং উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি এই মডেলটি বিশ্বজুড়ে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
চীনের বাজারে আইফোনের পুনরুত্থান: একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য
অ্যাপলের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক হলো চীনের বাজারে আইফোনের বিক্রি বৃদ্ধি। গত কয়েক বছর ধরে চীনের বাজারে আইফোনের বিক্রি অনেকটাই কমে গিয়েছিল, যা কোম্পানির জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে চীনের ভোক্তাদের মধ্যে আইফোনের প্রতি আগ্রহের পুনরুত্থান অ্যাপলের বৈশ্বিক বিক্রয়ে নতুন গতি এনেছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই বাজারে দখল ফিরে পাওয়া অ্যাপলের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বছরের শুরুর প্রতিকূলতা এবং অ্যাপলের অসাধারণ প্রত্যাবর্তন
বছরের শেষ দিকে আইফোন বিক্রি বৃদ্ধি এবং শেয়ারের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়া অ্যাপলের জন্য নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত সুসংবাদ। কারণ, চলতি বছরের শুরুতে কোম্পানিটি বেশ কয়েকটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের তোড়জোড় শুরু হয়, যা অ্যাপলের মতো বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরশীল একটি কোম্পানির জন্য মারাত্মক হুমকি ছিল। একই সময়ে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ভিত্তিক পণ্য বাজারে ছাড়তে বিলম্ব ঘটায় কোম্পানিটি প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে ছিল। এই সমস্ত প্রতিকূলতা মিলিয়ে অ্যাপলের অবস্থা বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। এমনকি, গত এপ্রিল মাসে এক দিনে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ৩১০ বিলিয়ন ডলার বা ৩১ হাজার কোটি ডলার কমে যায়, যা ছিল এক বিশাল আর্থিক ক্ষতি। তবে, সেই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে অ্যাপলের এই দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন তাদের শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতারই প্রমাণ। বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতের এই বিশাল কোম্পানি দারুণভাবে ব্যবসায়ের ধারায় এগিয়ে আসে, যা তাদের স্থিতিস্থাপকতা এবং ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে তুলে ধরে।
