গভীর সমুদ্রের বুকে ভাসমান এক বিলাসবহুল জাহাজ, যেখানে আলো ঝলমলে সান্ধ্য পার্টিতে আচমকা নেমে আসে রহস্যময় অন্ধকার—এমন দৃশ্যকল্প যখন গল্পের কেন্দ্রে থাকে, তখন পাঠক ও দর্শক উভয়ের মনেই এক দুর্নিবার কৌতূহল জাগে। সত্তরের দশকের সাড়া জাগানো ‘ডেথ অন দ্য নাইল’ (১৯৭৮) অথবা ‘দ্য লাস্ট অব শিলা’ (১৯৭৩)-এর মতো ক্লাসিক ক্রাইম থ্রিলারগুলো জাহাজের অভ্যন্তরে ঘটা রহস্যময় খুনের গল্পকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। এই ধারাকেই যেন নতুন করে পর্দায় আনার প্রচেষ্টা চালিয়েছে নেটফ্লিক্স, জনপ্রিয় লেখিকা রুথ ওয়ারের বেস্টসেলিং উপন্যাস ‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ অবলম্বনে নির্মিত একই নামের চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে।
উপন্যাসটির অনুরাগী এবং রহস্যপ্রেমী দর্শকদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে এক দারুণ অভিজ্ঞতা হতে পারত। সাইমন স্টোনের পরিচালনায় নির্মিত এই সিনেমাটি শুরুটা বেশ আশাব্যঞ্জক ছিল, যা দর্শককে কাহিনীর গভীরে টানতে সক্ষম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর পর ছবিটি তার রোমাঞ্চ ও টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত একটি মাঝারি মানের থ্রিলার হিসেবেই এর পরিচিতি গড়ে তুলেছে। তবুও, একটি নির্দিষ্ট সেটিংয়ে অপরাধের জাল বোনার এই প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে, বিশেষত যারা জাহাজের রহস্য পছন্দ করেন তাদের জন্য এটি ভিন্ন এক স্বাদ দিতে পারে।
‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’: এক ঝলকে
চলচ্চিত্রের নাম: দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম: নেটফ্লিক্স
ধরণ: ড্রামা, ক্রাইম থ্রিলার
পরিচালনা: সাইমন স্টোন
রান্টাইম: ১ ঘণ্টা ৩২ মিনিট
অভিনয়ে: কিরা নাইটলি, গাই পিয়ার্স, ডেভিড আজালা, গিটে উইট, আর্ট মালিক, হান্নাহ ওয়াডিংহাম, কায়া স্কোডেলারিও, পল কেয়ে প্রমুখ।
গভীর সমুদ্রের হাতছানি: লরার নতুন অ্যাসাইনমেন্ট
লন্ডনের এক প্রভাবশালী ও খ্যাতিমান অনুসন্ধানী সাংবাদিক লরা ব্ল্যাকলক (কিরা নাইটলি)। পেশাগত জীবনে তিনি বরাবরই সাহসী এবং আপোসহীন। সম্প্রতি তিনি একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও হাইপ্রোফাইল অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছিলেন, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তার বিশ্বস্ত সূত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যা লরার মনোজগতে গভীর আঘাত হানে। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার রেশ তার মধ্যে এতটাই গেঁথে যায় যে, কাজে ফিরে আসার পরও তিনি তীব্র মানসিক ট্রমা এবং উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি পিছু ছাড়ছিল না, যা তার পেশাগত দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছিল।
এই মানসিক অস্থিরতার মাঝেই লরা অপ্রত্যাশিতভাবে একটি তিন দিনের সমুদ্রযাত্রার আমন্ত্রণ পান। নরওয়ের এক ধনকুবের দম্পতি অ্যান লিংস্টাড (লিসা লোভেন কংসলি) ও তার স্বামী রিচার্ডের (গাই পিয়ার্স) একটি দাতব্য সংস্থার জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কভার করার জন্য তাকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটি ছিল এক অসাধারণ সুযোগ—একদিকে যেমন কাজের এক নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছিল, অন্যদিকে তেমনই মানসিক প্রশান্তির জন্য এই বিলাসবহুল সমুদ্রভ্রমণ এক অনবদ্য অবকাশের হাতছানি দিচ্ছিল। লরা এই সুযোগটি লুফে নেন, মনে মনে ভেবেছিলেন হয়তো এই যাত্রা তাকে পুরোনো কষ্ট ভুলিয়ে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা যোগাবে।
বিলাসবহুল সেই ক্রুজ জাহাজটি সমুদ্রে রওনা হয় হাতে গোনা কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তি এবং ক্রুদের নিয়ে। এটি কেবল একটি যাত্রা ছিল না, বরং সমাজের crème de la crème অর্থাৎ উচ্চবিত্ত ও প্রভাবশালী মহলের এক সীমিত পরিসরের মিলনমেলা। এই জাহাজে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং ধনকুবের দম্পতি অ্যান ও রিচার্ড, যারা এই দাতব্য সংস্থার মূল উদ্যোক্তা। লরা ব্ল্যাকলক সেখানে এসেছিলেন সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে। এছাড়াও এই বিশেষ যাত্রায় তার পুরোনো প্রেমিক ও আলোকচিত্রী বেঞ্জামিন (ডেভিড আজালা)-এর উপস্থিতি ঘটনাপ্রবাহে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
এছাড়াও এই অভিজাত অতিথিদের তালিকায় ছিলেন এক ধনী গ্যালারিস্ট হেইডি (হান্নাহ ওয়াডিংহাম) ও তার স্বামী, অ্যানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক (আর্ট মালিক) এবং বিখ্যাত রকস্টার ড্যানি টাইলার (পল কেয়ে)। প্রতিটি চরিত্রই যেন নিজেদের মধ্যে এক রহস্যের আবরণ নিয়ে এই জাহাজে পা রেখেছিল। এই সীমিত পরিসরের বিলাসবহুল পরিবেশে, যেখানে সবাই একে অপরের পরিচিত বা প্রভাবশালী, সেখানেই কাহিনীর মূল রহস্যের বীজ রোপিত হয়। কেবিন ১০-এর সেই নারী কে, আর কেনই বা তার উপস্থিতি এই আপাত শান্ত যাত্রায় এক অস্থিরতার জন্ম দেবে, তা জানতে হলে দর্শকদের ডুব দিতে হবে এই রোমাঞ্চকর ক্রাইম থ্রিলারের গভীরে।
