বলিউডের চিরন্তন এক বিতর্ক হলো তিন খান—শাহরুখ খান, সালমান খান এবং আমির খান—এর মধ্যে কে সত্যিকার অর্থে ইন্ডাস্ট্রির ‘বাদশা’ বা সবচেয়ে প্রভাবশালী তারকা। এই দীর্ঘদিনের আলোচনায় এবার নিজস্ব, খোলামেলা মতামত জানিয়েছেন বলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার অনুরাগ কাশ্যপ। সম্প্রতি এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এই তিন মহাতারকার জনপ্রিয়তা, কর্মনিষ্ঠা এবং ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের অবদান নিয়ে তার সুচিন্তিত বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন, যা দ্রুতই চলচ্চিত্র মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কাশ্যপের এই মন্তব্য শুধু তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণই নয়, এটি বলিউডের বর্তমান তারকা বিন্যাস এবং আগামী দিনের সম্ভাবনার উপরও আলোকপাত করেছে।
অনুরাগ কাশ্যপের স্পষ্টবাদী বিশ্লেষণ
চলচ্চিত্র সমালোচক কোমল নাহাটার সঙ্গে এক গভীর আলাপচারিতায়, ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ খ্যাত এই ব্যতিক্রমী নির্মাতা তার পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত করেন। কাশ্যপ দৃঢ়তার সঙ্গে জানান যে, জনপ্রিয়তার নিরিখে শাহরুখ খান নিঃসন্দেহে শীর্ষে অবস্থান করছেন। তার ঠিক পরেই রয়েছেন সালমান খান, এবং সবশেষে আমির খান। তবে, জনপ্রিয়তার এই মাপকাঠির বাইরে গিয়ে, কাশ্যপ আমির খানকেই সবচেয়ে পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান অভিনেতা ও নির্মাতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার এই মন্তব্য একদিকে যেমন শাহরুখের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তেমনই আমিরের কাজের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পেয়েছে, যিনি প্রায়শই অভিনব গল্প এবং গভীর চরিত্রায়ণে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
কাশ্যপের এই সরাসরি এবং কিছুটা বিতর্কিত মন্তব্যটি দ্রুতই চলচ্চিত্র মহলে এক নতুন আলোচনার ঢেউ তুলেছে। বহু চলচ্চিত্র বিশ্লেষক এবং দর্শক তার এই মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন, বিশেষত শাহরুখ খানের অসামান্য গ্লোবাল ফ্যানবেস এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার একচ্ছত্র আধিপত্যের বিষয়টি আবারও প্রমাণিত হয়েছে। তার ক্যারিশমা এবং বৈশ্বিক আবেদন আজও বলিউডকে এক ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে রেখেছে, যা তাকে এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে। অন্যদিকে, আমিরের মেথড অ্যাক্টিং এবং প্রতি প্রজেক্টে তার নিবিষ্টতা প্রায়শই সিনেমার গুণগত মানকে নতুন মাত্রা দেয়, যা কাশ্যপের মন্তব্যের মূল ভিত্তি।
খানদের সঙ্গে সম্পর্কের জটিল সমীকরণ
যদিও অনুরাগ কাশ্যপ তিন খানের জনপ্রিয়তা ও কর্মনিষ্ঠার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, তার নিজের পরিচালনায় এখন পর্যন্ত এই তিন মহাতারকার কেউই কাজ করেননি। মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বাইরে গিয়ে ভিন্নধর্মী, বাস্তববাদী এবং প্রায়শই সাহসী গল্পের চিত্রায়নের জন্য কাশ্যপ বরাবরই পরিচিত। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো সাধারণত শক্তিশালী চিত্রনাট্য এবং চরিত্রাভিনেতাদের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়, যা বলিউডের প্রচলিত তারকা নির্ভর ফর্মুলা থেকে অনেকটাই আলাদা। সম্ভবত এই কারণেই বলিউডের ‘খান’ সাম্রাজ্যের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ কর্মসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, কারণ তার চলচ্চিত্রের ধরন তারকাদের প্রচলিত ইমেজ থেকে অনেক সময়ই ভিন্ন হয়।
তবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে একবার শাহরুখ খানের সঙ্গে পর্দা ভাগ করেছিলেন কাশ্যপ। সেটি কোনো পূর্ণাঙ্গ বা প্রধান চরিত্রে অভিনয় ছিল না, বরং জয়া আখতারের প্রশংসিত চলচ্চিত্র ‘লাক বাই চান্স’ (২০০৯)-এ তাদের দু’জনকে একসঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল। এটি ছিল অনেকটা একটি বন্ধুত্বপূর্ণ উপস্থিতি, যা তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে, কিন্তু পেশাদার কাজের ক্ষেত্রে তাদের পথ ছিল ভিন্ন।
অন্যদিকে, অনুরাগের ছোট ভাই অভিনব কাশ্যপ বলিউডের ভাইজান সালমান খানের সঙ্গে কাজ করে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিলেন। ২০১০ সালের সুপারহিট ছবি ‘দাবাং’-এর পরিচালনা করেছিলেন অভিনব। ছবিটি বক্স অফিসে রেকর্ড গড়েছিল এবং সালমান খানের ক্যারিয়ারে এক নতুন মোড় এনেছিল। তবে, এই ছবির ব্যাপক সাফল্যের পরই দুই ভাই—অনুরাগ এবং অভিনবের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়, যার কারণ আজও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। এই দূরত্ব এখনো পুরোপুরি কাটেনি, যা চলচ্চিত্র মহলে এক রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে। এই ঘটনা খানদের সঙ্গে কাশ্যপ পরিবারের সম্পর্কের জটিলতা আরও বাড়িয়ে তোলে এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত সম্পর্কের সূক্ষ্ম দিকগুলো সামনে নিয়ে আসে।
ঐতিহাসিক যুগলবন্দির ইঙ্গিত
চলচ্চিত্র মহলে যখন এই বিতর্ক ও সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে, ঠিক তখনই এক ঐতিহাসিক ঘটনার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সম্প্রতি শাহরুখ খান, সালমান খান এবং আমির খান—এই তিন মহাতারকা সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত জয় ফোরাম ২০২৫-এ একসঙ্গে উপস্থিত হয়েছিলেন। এটি ছিল একটি বিরল দৃশ্য, যা একসঙ্গে তিন খানকে এক মঞ্চে দেখার বহু পুরনো আকাঙ্ক্ষাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে এবং বিশ্বব্যাপী তাদের ভক্তদের মধ্যে বিপুল কৌতূহল সৃষ্টি করে।
এই ফোরামে তারা প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ভবিষ্যতে তাদের তিনজনকে নিয়ে একটি যুগান্তকারী চলচ্চিত্র প্রকল্প নির্মিত হতে পারে। যদিও এই মহাপ্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য এখনো পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি, তবে এই ঘোষণা পুরো বলিউড এবং তাদের অগণিত ভক্তদের মধ্যে বিশাল উত্তেজনা তৈরি করেছে। যদি সত্যিই এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে, যা সিনেমার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
এটি কেবল একটি চলচ্চিত্র হবে না, বরং বলিউডের ক্ষমতা, ঐক্য এবং তিন দশকের কিংবদন্তি অভিনেতাদের এক মঞ্চে নিয়ে আসার এক ঐতিহাসিক প্রয়াস হবে। এই সম্ভাব্য যুগলবন্দি ভবিষ্যতে ভারতীয় সিনেমার গতিপথ পাল্টে দিতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব ফেলবে, যা আগামী প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং তারকাদের একত্রিত করার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।
