More

    ‘দেলুপি’ সিনেমায় কী আছে

    সৃষ্টিকর্মের জন্ম কখনো কখনো জেলের ছিপে ধরা পড়া এক অমূল্য মাছের মতোই অনিশ্চিত, রোমাঞ্চকর এবং অতীব ফলপ্রসূ। পরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম তাঁর নতুন চলচ্চিত্র ‘দেলুপি’-এর গল্প খুঁজে পাওয়ার এই যাত্রাকে বর্ণনা করেছেন ঠিক এভাবেই – টোপ ফেলা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিশ্চিত ছিল না কোনো শিকারের। অবশেষে, প্রকৃতির এক অনন্য উপহার যেন তাঁর জালে ধরা দিল, যা পরবর্তীতে রূপ নিল এক অনবদ্য cinematic অভিজ্ঞতায়।

    বিপর্যয় থেকে সৃষ্টির উৎস: দেলুটির পথে

    ২০২৪ সালের আগস্ট মাসটি খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছিল এক চরম বিপর্যয়। ভদ্রা নদীর বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল, ভেসে গিয়েছিল বসতভিটা আর ফসলের মাঠ। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে যখন স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে নিজেদের জীবন ও বাস্তুভিটা রক্ষায় মরণপণ সংগ্রাম করছিল, ঠিক তখনই দেশের সংবাদমাধ্যমে ভেসে আসে তাদের এই অদম্য প্রতিরোধের খবর। সেই খবরই পরিচালক তাওকীর ইসলামের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মানবিকতার টানে, দেলুটির মানুষদের জীবন সংগ্রামকে ক্যামেরাবন্দী করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি এবং তাঁর আরও পাঁচজন সহকর্মী ছুটে যান খুলনার সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

    খুলনা শহরের ব্যস্ততা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় এই দেলুটি ইউনিয়নে। ইউনিয়নের তেরোটি গ্রাম এখনো আধুনিকতার চাকচিক্য থেকে বহু দূরে, যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানকার জীবনযাত্রা প্রকৃতির সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ, যেখানে প্রযুক্তির চেয়েও মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা আর প্রকৃতির খেয়ালের প্রভাবই বেশি প্রকট। এই দুর্গম এলাকার কালীনগর কলেজে আশ্রয় নেন তাওকীর ও তাঁর দল। তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দেলুটির ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করা, যা সেখানকার মানুষের জীবন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের অদম্য স্পৃহাকে তুলে ধরবে।

    তথ্যচিত্র থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র: গল্পের উন্মোচন

    প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ, কিন্তু দেলুটির মাটি আর মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর সে ভাবনা বদলে যায়। তাওকীর ইসলাম বলেন, ‘প্রথমত, আমাদের মাথায় কোনো ফিচার ফিল্মের গল্প ছিল না। আমরা শুধু এখানকার জীবনকে কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিলাম।’ দীর্ঘ সময় ধরে দেলুটির কালীনগর কলেজেই তারা আশ্রয় নেন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষদের সঙ্গে দিন কাটাতে শুরু করেন। এই নিবিড় সাহচর্যেই চলচ্চিত্রের গল্পের বীজ বোনা হয়। খুব কাছ থেকে সেখানকার মানুষের হাসি-কান্না, সংগ্রাম আর ভালোবাসার পরশ পেতে পেতে পরিচালক অনুধাবন করেন যে, এই জীবন কাহিনি শুধু একটি তথ্যচিত্রে সীমাবদ্ধ রাখার মতো নয়। ধীরে ধীরে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য আকার নিতে শুরু করে এবং একইসাথে চলচ্চিত্রের জন্য প্রয়োজনীয় চরিত্র ও লোকেশনও চূড়ান্ত করা হয়।

    নির্মাতা আরও জানান যে, সিনেমার নামকরণ করা হয়েছে ‘দেলুপি’ – এই ইউনিয়নের নাম থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে। চলচ্চিত্রের গল্প এবং এর বেশিরভাগ চরিত্রই দেলুটি ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের জীবন ও অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে, যা এটিকে একটি অনন্য ও বাস্তবসম্মত মাত্রা দিয়েছে।

    অপরিচিত মুখ, অচেনা অভিনয়: বিশ্বাস আর ভালোবাসার সেতু

    পরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম বরাবরই স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, এবং ‘দেলুপি’ ছবিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন স্বয়ং দেলুটি ইউনিয়নের সাধারণ মানুষেরা, যাদের অভিনয় জগতে পূর্বে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এই অসাধ্য সাধন কীভাবে সম্ভব হলো? তাওকীর ইসলামের ভাষ্যমতে, ‘সাধারণত, তারা নিজেদেরকে কেবল দর্শক হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। সিনেমায় যে তারাও কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠতে পারে, তাদের দৈনন্দিন জীবনই এক অসাধারণ গল্প হয়ে ধরা দিতে পারে – এই ধারণা তাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন ছিল।’

    দীর্ঘ সময় ধরে তাদের সঙ্গে বসবাস, তাদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন এবং তাদের সংস্কৃতিকে গভীরভাবে বোঝার মাধ্যমেই পরিচালক তাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। দিনের পর দিন তাদের সঙ্গে মিশে, তাদের স্বপ্ন ও আশার কথা শুনে তিনি একটি বিশ্বাসের মজবুত ভিত্তি তৈরি করেন, যা তাদের ক্যামেরার সামনে স্বাচ্ছন্দ্যে দাঁড়াতে সাহায্য করে। ‘দেলুপি’ তাই কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি দেলুটির মানুষের সঙ্গে তাওকীর ইসলামের গড়ে তোলা এক গভীর সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি।

    ক্যামেরাবন্দী সংগ্রাম: শুটিং ও পোস্ট-প্রোডাকশন

    গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষভাগে দেলুটির প্রাকৃতিক পরিবেশে এই চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু হয়। একটানা কাজ করার পর অক্টোবরের শেষভাগে সাফল্যের সাথে দৃশ্যধারণের কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর পোস্ট-প্রোডাকশনের সমস্ত কাজ পরিচালক ঢাকাতে সম্পন্ন করেন, যেখানে চলচ্চিত্রের প্রতিটি ফ্রেমকে নিখুঁত রূপ দেওয়া হয়। ‘দেলুপি’ এখন মুক্তির অপেক্ষায়, যা দর্শকদের কাছে দেলুটির মানুষের অদম্য প্রাণশক্তি আর একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প তুলে ধরবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here