More

    সেই ১৫ সেনা কর্মকর্তার পক্ষে লড়বেন না ব্যারিস্টার সারওয়ার

    বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে, বিশেষত স্পর্শকাতর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়, আইনি পেশার নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতা এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায়, ব্যারিস্টার এম সারওয়ার হোসেন তাঁর পেশাগত নীতিমালার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংঘটিত গুম ও অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের পক্ষে আইনি লড়াই থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, যা আইনি মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

    আইনি লড়াই থেকে ব্যারিস্টার সারওয়ার হোসেনের প্রত্যাহার

    রবিবার, ৯ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ একটি বিশেষ শুনানিতে ব্যারিস্টার এম সারওয়ার হোসেন এই মামলার আইনজীবী প্যানেল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহারের আবেদন জানান। ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদনটি তাৎক্ষণিকভাবে মঞ্জুর করে, যা মামলার গতিপথে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পেশাগত সততা ও নৈতিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিচারিক স্বচ্ছতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

    আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ব্যারিস্টার সারওয়ার হোসেন তাঁর সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, গত ২২ অক্টোবর, তিনি সহ মোট পাঁচজন আইনজীবী ১৫ জন সেনা কর্মকর্তার পক্ষে ওকালতনামা দাখিল করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে তিনি উপলব্ধি করেন যে, এই মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তিও রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে তিনি নিজেই পূর্বে একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। এই তথ্য উন্মোচিত হওয়ার পরই তাঁর পেশাগত দ্বিধা তৈরি হয়।

    তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, “পেশাগত নৈতিকতা ও আচরণবিধি অনুযায়ী, আমার পক্ষে ওই মামলায় ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে কাজ করা সম্ভব নয়। এটি সরাসরি স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।” তাই, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইনের সুনির্দিষ্ট বিধান এবং আইনজীবী হিসেবে তাঁর নিজস্ব পেশাগত নৈতিকতার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হয়ে তিনি নাম প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলেন, যা আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়। এই পদক্ষেপ আইনের শাসন এবং বিচারিক পেশার পবিত্রতার প্রতি তাঁর গভীর নিষ্ঠার প্রতিফলন।

    মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিবরণ

    বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি পৃথক মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে সংঘটিত গুম ও নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কিত। এই অভিযোগগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এবং মানবাধিকার কর্মীদের পক্ষ থেকে এর নিবিড় তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।

    তৃতীয় মামলাটি দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে রাজধানী ঢাকার রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত। এই মামলাগুলো বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এগুলোর ফলাফল ভবিষ্যতে মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

    অভিযুক্তদের তালিকা ও বর্তমান অবস্থা

    এই তিনটি গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় মোট ৩২ জন ব্যক্তি অভিযুক্ত হয়েছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন ও বর্তমান ২৫ জন সেনা কর্মকর্তা। এই ১৫ জন সেনা কর্মকর্তা বর্তমানে ঢাকা সেনানিবাসের সাবজেলে আটক অবস্থায় রয়েছেন, যা মামলার সংবেদনশীলতা ও গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে আইনি প্রক্রিয়া পুরোদমে চলমান।

    গুম ও নির্যাতন সংক্রান্ত একটি নির্দিষ্ট মামলায় ১৭ জন আসামি রয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন, যাদের নাম নিচে দেওয়া হলো:

    • ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম: র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক।
    • ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার।
    • ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান।
    • ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম।
    • ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ।
    • কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন।
    • কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান: (অবসরকালীন ছুটিতে)।
    • র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাব-পরিচালক সহ আরও অনেকে।

    এই মামলাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়া দেশের আইনি কাঠামোর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here