দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে দায়ের করা আপিলের দীর্ঘ ও নিবিড় শুনানি সম্প্রতি শেষ হয়েছে, এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আগামী ২০ নভেম্বর এই ঐতিহাসিক মামলার রায় ঘোষণা করবেন। এই রায় দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
গত মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর (Assuming this is the Tuesday on which the announcement of the verdict date was made), প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এই রায়ের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ ধার্য করেন। টানা দশ কার্যদিবস ধরে চলা যুক্তিতর্ক, আইনি ব্যাখ্যা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারিক পর্যালোচনার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন। এই দীর্ঘকালীন শুনানি দেশের বিচারিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
আপিল বেঞ্চের সম্মানিত বিচারকবৃন্দ
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের অন্য ছয় সম্মানিত বিচারপতি হলেন: বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। এই অভিজ্ঞ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মামলার সকল জটিল দিক বিশ্লেষণ করেছেন, যা রায়ের গভীরতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শুনানিতে অংশ নেওয়া বিজ্ঞ আইনজীবীগণ
এই মামলায় বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী বিজ্ঞ আইনজীবীরা তাদের মক্কেলদের পক্ষে শক্তিশালী এবং সুচিন্তিত যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।
- রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সুপরিচিত আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। তিনি তাঁর যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করেন।
- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষে আইনি লড়াইয়ে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন এবং ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তাঁদের যুক্তি ছিল দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য।
- জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনিও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেন।
- বিভিন্ন পক্ষের হস্তক্ষেপকারী (ইন্টারভেনর) হিসেবে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ এবং ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে আদালতের সামনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আইনি ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।
- রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক। তাঁদের প্রধান যুক্তি ছিল বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর সুরক্ষা এবং আদালতের পূর্ববর্তী রায়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
মামলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আপিলের ধারাবাহিকতা
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে দায়ের করা এই আপিলের শুনানি গত ২১ অক্টোবর তারিখে শুরু হয়েছিল। এর পূর্বে, গত ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পূর্ববর্তী রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য করা আবেদনের শুনানি শেষে আপিলের অনুমতি প্রদান করা হয়। এই অনুমতি ছিল মামলার গতিপথ পরিবর্তনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা পুনরায় দেশের রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
পরবর্তীতে, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার পৃথকভাবে এই আপিলগুলো দায়ের করেন। এই আপিলগুলো মূলত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত হয়েছিল, যা পূর্বে আদালতের একটি ঐতিহাসিক রায়ে বাতিল করা হয়। সেই বাতিল হওয়া ব্যবস্থার পুনর্জন্মের দাবি নিয়ে এই মামলার রায় দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের সকল মহলের দৃষ্টি এখন ২০ নভেম্বরের দিকে, যখন সর্বোচ্চ আদালত তাদের চূড়ান্ত ও ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করবেন।
