More

    নির্বাচনি প্রচারণায় পোস্টার নিষিদ্ধ

    নির্বাচনী প্রচারণার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরিবেশ দূষণ রোধ, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক প্রচারণার অপব্যবহার ঠেকাতে নতুন কিছু কঠোর বিধিমালা জারি করা হয়েছে। এই নতুন নির্দেশনার আওতায় প্রথমবারের মতো নির্বাচনী পোস্টার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ড্রোন ব্যবহার এবং দেশের বাইরে থেকে নির্বাচনী প্রচারণার ওপরও আরোপ করা হয়েছে সুদূরপ্রসারী নিষেধাজ্ঞা। এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, পরিবেশবান্ধব এবং ন্যায্য করতে ইসির দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতিফলন।

    নবীন বিধিমালা: গেজেট প্রকাশ ও এর ভিত্তি

    গত সোমবার (১১ নভেম্বর) রাতে নির্বাচন কমিশন এই নতুন বিধিমালাগুলো গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। এই গেজেট প্রকাশ একটি সুচিন্তিত প্রক্রিয়ার ফসল, যা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনী আচরণবিধির সঙ্গে সুসমন্বয় রেখে প্রণীত হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসি কেবল বিদ্যমান আইনের দুর্বলতাগুলো দূর করেনি, বরং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক নির্বাচনী প্রচারণার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায়ও প্রস্তুত হয়েছে। এই বিধিমালা কার্যকর হলে বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

    প্রচারণার ধরন ও সীমাবদ্ধতা: পোস্টার, বিলবোর্ড এবং ড্রোন

    নির্বাচনী প্রচারণায় যে পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পোস্টার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধকরণ। এই সিদ্ধান্তের পেছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করেছে: প্রথমত, পরিবেশ দূষণ রোধ; এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণ। ঐতিহ্যগতভাবে, পোস্টার একটি প্রধান প্রচার মাধ্যম হলেও এর ফলে প্রচুর কাগজ অপচয় হয় এবং নির্বাচনের পর এগুলো অপসারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, যা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইসি এই পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি সবুজ ও টেকসই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দিকে জোর দিচ্ছে।

    পোস্টার নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি, অন্যান্য প্রচলিত প্রচার মাধ্যমগুলোর ওপরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এখন থেকে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২০টির বেশি বিলবোর্ড, ব্যানার বা ফেস্টুন ব্যবহার করতে পারবেন না। এই সীমা নির্ধারণের উদ্দেশ্য হলো প্রচারণার বাড়াবাড়ি কমানো এবং সকল প্রার্থীর জন্য একটি সমান সুযোগ তৈরি করা, যেখানে অর্থবিত্তের প্রভাব কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। এছাড়া, ইসি পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে যে, ‘ড্রোন ব্যবহার ও বিদেশে প্রচারণা কার্যক্রমে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা থাকবে।’ ড্রোনের মাধ্যমে প্রচারণার ওপর নিষেধাজ্ঞা মূলত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে এবং বিদেশে প্রচারণার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিদেশি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখতে সহায়ক হবে।

    ডিজিটাল প্রচারণার নিয়ন্ত্রণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার

    আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্বাচনী প্রচারণার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর অপব্যবহারও ব্যাপক। নতুন বিধিমালা এই দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো গুজব, মিথ্যা তথ্য এবং বিদ্বেষমূলক প্রচারণার বিস্তার রোধ করা। বিশেষ করে, অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে প্রচারণা চালানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ডিপফেক বা এআই-জেনারেটেড ভয়েস ব্যবহার করে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার যে কোনো প্রচেষ্টা রুখে দেওয়াই এই নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য করবে।

    প্রার্থীদের নতুন অঙ্গীকার ও ইশতেহার ঘোষণা

    নতুন বিধিমালার আওতায় প্রার্থীদের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে সকল প্রার্থীকে আচরণবিধি মেনে চলার অঙ্গীকারনামা ইসিতে জমা দিতে হবে। এটি প্রার্থীর প্রতি একটি নৈতিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করবে, যা তাদের দায়িত্বশীল আচরণে উৎসাহিত করবে। এছাড়াও, একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে, প্রথমবারের মতো সব প্রার্থীকে একই মঞ্চে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করতে হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সকল প্রার্থীকে সমান সুযোগ দেওয়া হবে এবং ভোটাররা এক ছাতার নিচে বিভিন্ন দলের প্রতিশ্রুতিগুলো তুলনামূলকভাবে যাচাই করার সুযোগ পাবেন। এটি নির্বাচনী বিতর্কের মান উন্নয়নেও সহায়ক হবে।

    বিধিমালা লঙ্ঘনের কঠোর শাস্তি

    বিধিমালাগুলো কেবল প্রণয়নই করা হয়নি, বরং এর লঙ্ঘনের জন্য কঠোর শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। কোনো প্রার্থী যদি আচরণবিধি ভঙ্গ করেন, তবে তাকে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হতে পারে। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও একই পরিমাণ অর্থাৎ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, যা দলের প্রতিও সতর্ক বার্তা বহন করে। সবচেয়ে গুরুতর লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে, একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতাও ইসিকে দেওয়া হয়েছে। এটি ইসির ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশুদ্ধতা রক্ষায় তাদের হাতকে আরও মজবুত করবে। এই কঠোর শাস্তির বিধানগুলো নির্বাচনী শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের নিরুৎসাহিত করতে অত্যন্ত কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here