More

    সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে: প্রধান উপদেষ্টা

    বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক কাঠামো এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত রূপরেখা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বা সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের এই পদ্ধতি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির মাধ্যমে গঠিত হবে, যা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আরও ব্যাপক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

    বৃহস্পতিবার (তারিখ উল্লেখ নেই, তবে মূল খবরে বৃহস্পতিবার ছিল) বেলা আড়াইটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস এই বিস্তারিত পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তাঁর ভাষণের পূর্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এক জরুরি বৈঠকে বসে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো চূড়ান্ত করা হয়।

    গণভোট ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের গঠনপ্রক্রিয়া

    প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সংবিধান সংস্কারের একটি সুসংগঠিত এবং জনমত-ভিত্তিক পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি জানান, যদি প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারের ওপর আয়োজিত গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত ‘হ্যাঁ’ সূচক হয়, তবে তা সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট জনরায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এই জনরায়ের ভিত্তিতে আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে।

    এই পরিষদ সদস্যদের দ্বৈত ভূমিকা থাকবে: তাঁরা একইসঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করবেন এবং সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হবেন। এটি নিশ্চিত করবে যে, সংবিধান সংস্কারের কাজটি জননির্বাচিত প্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, পরিষদ তার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করবে। এই সময়সীমা সংস্কার প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে দেশের শাসনতান্ত্রিক স্থবিরতা কাটিয়ে একটি আধুনিক ও জনমুখী সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা যায়।

    উচ্চকক্ষ গঠন ও এর কার্যকাল

    সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পর, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সংবিধান সংস্কার শেষ হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে এই উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে, যা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও আইন প্রণয়নে বৈচিত্র্য আনতে সহায়ক হবে।

    নবগঠিত এই উচ্চকক্ষের মেয়াদ হবে নিম্নকক্ষের শেষ কার্যদিবস পর্যন্ত। এর ফলে সংসদের উভয় কক্ষের মধ্যে একটি কার্যকর ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং আইন প্রণয়ন ও পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকতা আসবে। উচ্চকক্ষকে সাধারণত আইন পর্যালোচনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ হিসেবে দেখা হয়, যা তাড়াহুড়ো করে নেওয়া সিদ্ধান্ত বা আইনের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে আরও পরিপক্ক আইন প্রণয়নে সাহায্য করে।

    ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’

    প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ঠিক আগে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়। এই আদেশটি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো হিসেবে কাজ করবে। প্রধান উপদেষ্টা জানান যে, প্রয়োজনীয় সকল স্বাক্ষর সম্পন্ন হওয়ার পর এটি ইতোমধ্যে গেজেট নোটিফিকেশন করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এই আদেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হবে এবং সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য একটি স্পষ্ট আইনি ভিত্তি প্রদান করবে।

    এই আদেশে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সনদের সংবিধান বিষয়ক সংস্কার প্রস্তাবনার ওপর গণভোট অনুষ্ঠান এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত। এই বিধানগুলো নিশ্চিত করে যে, সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক জনসমর্থন প্রয়োজন এবং জনমতের ভিত্তিতেই সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

    একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট: একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

    একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারের ওপর গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ, জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। এই সিদ্ধান্ত একইসঙ্গে জনগণের প্রতিনিধিদের নির্বাচন এবং দেশের সাংবিধানিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সরাসরি মতামত প্রদানের সুযোগ দেবে, যা একটি সমন্বিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

    একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ফলে জনগণের অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি শুধু একটি নতুন সংসদই নির্বাচন করবে না, বরং দেশের সর্বোচ্চ আইন, সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের জন্য একটি শক্তিশালী জনমতের ভিত্তিও তৈরি করবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি নতুন সাংবিধানিক যুগে প্রবেশ করতে চলেছে, যেখানে জনগণের সরাসরি মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here