প্রকৃতির এক অবিস্মরণীয় বিস্ময় হলো পরিযায়ী পাখিদের সুদূর যাত্রা। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে উষ্ণতর অঞ্চলের সন্ধানে ডানা ঝাপটিয়ে আসে তারা। এই যাত্রাপথের এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। কিন্তু কী নিদারুণ পরিহাস, যে মুহূর্তে এই ক্লান্ত পাখিরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চায়, ঠিক সে মুহূর্তে একদল নির্দয় মানুষের শিকারে পরিণত হয় তারা। সামান্য কিছু মাংসের লোভে তাদের নিরীহ জীবন কেড়ে নিয়ে মেতে ওঠা হয় এক পাশবিক উৎসবে। প্রকৃতির প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা এবং প্রাণিকুলের প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া-মমতার অভাব আমাদের সমাজের এক গভীর ক্ষতকে উন্মোচন করে।
আমাদের নৈতিকতার এই অধঃপতন কেবল বন্যপ্রাণীর প্রতি সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের পিছিয়ে পড়া, যারা আশ্রয় বা ভালোবাসার বড় বেশি কাঙাল, তাদের প্রতিও আমাদের সহানুভূতি প্রায়শই অনুপস্থিত। দয়া, মমতা এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা—এই মৌলিক মানবিক গুণগুলো নিয়ে বেড়ে ওঠার শিক্ষা আমাদের অনেকের মধ্যেই রয়ে গেছে অপূর্ণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই অভাব আরও প্রকটভাবে ধরা পড়ে।
আমরা অনেকেই ভুলে গেছি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব। বৃদ্ধ মা-বাবাকে সম্মান জানাতে, তাদের শেষ বয়সের অবলম্বন হতে আমরা ব্যর্থ হই। আমাদের পিতৃতুল্য শিক্ষকের প্রতি সম্মানজনক আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সেই শিক্ষা আমাদের অনেকেরই নেই। ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত, তাদের কোমল মনকে আঘাত না করে কীভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা উচিত, তা আমরা জানি না। সমাজের প্রতিটি স্তরে, পরিবারের অভ্যন্তরেও এই মানবিক মূল্যবোধের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অনেক পরিবারে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু রয়েছে। এই বিশেষ শিশুটি যখন পরিবারে বেড়ে ওঠে, তখন তার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ যত্ন, সহমর্মিতা এবং সমাজের মূলস্রোতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার সযত্ন প্রয়াস। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাদের বিশেষত্বকে সাদরে গ্রহণ করার এবং তাদের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে আমাদের রয়েছে গভীর শিক্ষার অভাব, সংবেদনশীলতার ঘাটতি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান অহেতুক প্রতিযোগিতা এবং মারাত্মক বৈষম্য এই দুর্বলতাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে, যা মানবিকতার উপর এক কালো ছায়া ফেলে।
পরগাছার মতো জীবন: বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের বঞ্চনা
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষজন, যারা শারীরিক, মানসিক বা পারিপার্শ্বিক কারণে কিছুটা ভিন্ন, তাদের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ যত্ন ও মনোযোগ। তারাও আদর বোঝে, ভালোবাসার ভাষা উপলব্ধি করে, তাদের আত্মসম্মানবোধ আছে, আছে স্বপ্ন আর দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতায় পদে পদে বঞ্চনার শিকার হতে হতে, সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হতে তারা যেন আপনজন, সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে পরগাছার মতো জীবন ধারণে বাধ্য হয়। এই বঞ্চনা তাদের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেয়, তাদের প্রতিভাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। অথচ তাদের অনেকের মধ্যেই এমন সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে থাকে, যা স্বাভাবিক অনেক শিশুর চেয়েও বেশি উজ্জ্বল। একটু সহানুভূতি ও সঠিক পরিচর্যা পেলে তারাও সমাজের মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের চারপাশে একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখতে পাই, কত বিচিত্র মানুষের বাস। কেউ স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় শারীরিক গঠনে বা কর্মদক্ষতায় ভিন্ন, কেউ মানসিক বা সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতায় পিছিয়ে আছে। কারও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিক, কারও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ধীর, আবার কারও দেখা বা শোনার ক্ষেত্রে রয়েছে জন্মগত সমস্যা। অনেকে আবার সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন ও যোগাযোগে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। তাদের আচরণও অন্যের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে, যা অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দেয়। এই ভিন্নতার পেছনে থাকতে পারে জিনগত সমস্যা, জন্মপূর্ব বা জন্মকালীন জটিলতা, অপুষ্টি, দুর্ঘটনা কিংবা পরিবেশগত বিভিন্ন কারণ। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রয়োজন আমাদের সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের প্রতি সমর্থন ও অন্তর্ভুক্তির নিশ্চিতকরণ, যাতে তারাও মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে এবং নিজেদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পায়।
