More

    রাজশাহীতে বিচারকের ছেলেকে সম্ভবত শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে: পুলিশ

    রাজশাহী মহানগরীতে ঘটেছে এক মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের কিশোর বয়সী ছেলে তাওসিফ রহমান (সুমন) নিজ ভাড়া বাসাতেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত সুমনের গলায় শ্বাসরোধের সুস্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং তার পায়ের আঙুলেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। এই বর্বরোচিত ঘটনা বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট মহলে এবং সাধারণ জনমনে গভীর উদ্বেগ ও শোকের ছায়া ফেলেছে। এমন একটি শান্তিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় ঘটে যাওয়া এই নৃশংসতা সকলের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

    হৃদয়বিদারক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ

    বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বেলা আড়াইটার পর রাজশাহী নগরের ডাবতলা এলাকায় বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের ভাড়া বাসায় এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। নিহত তাওসিফ রহমান সুমন (১৫) নবম শ্রেণির একজন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী ছিলেন। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, তাকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের আকস্মিকতা ও নির্মমতা পরিবার এবং প্রতিবেশীদের গভীরভাবে হতবাক করেছে।

    এই মর্মান্তিক হামলায় বিচারকের স্ত্রী, তাসমিন নাহার (৪৪), নিজেও গুরুতর আহত হয়েছেন। ঘাতকের ছুরিকাঘাতে তিনি জখম হন। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, যেখানে তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং তার শারীরিক অবস্থার নিবিড় পর্যবেক্ষণ চলছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে লিমন মিয়া (৩৫) নামের এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করেছে। লিমন নিজেও হামলায় আহত হওয়ায় তাকেও একই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্ত লিমন মিয়া গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনেরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।

    পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত ও ঘটনার গতিপথ

    রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গাজিউর রহমান গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি জানান, বিচারকের ছেলে তাওসিফ রহমানকে সম্ভবত শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে। তার গলায় শ্বাসরোধের সুস্পষ্ট আলামত দৃশ্যমান ছিল, যা ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে আরও নিশ্চিত করা হবে। এছাড়াও তার হাঁটুর নিচে এক পায়ের আঙুলেও ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা এই হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা এবং শারীরিক ধস্তাধস্তির ইঙ্গিত দেয়।

    পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত ও প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অভিযুক্ত লিমন মিয়া একটি ব্যাগ নিয়ে বিচারকের বাসায় প্রবেশ করে। সে প্রথমে ডাইনিং টেবিলে বসে বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহারের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথোপকথন চালিয়ে যায়। এই কথোপকথনের একপর্যায়ে, লিমন হঠাৎ করেই অস্বাভাবিকভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং তার ব্যাগ থেকে একটি ধারালো ছুরি বের করে। পরিস্থিতি দ্রুত প্রতিকূল হয়ে উঠতে দেখে তাসমিন নাহার দ্রুত একটি কক্ষে ঢুকে নিজেকে ভেতর থেকে সিটকিনি দিয়ে সুরক্ষিত করেন।

    তবে, ঘাতক লিমন মিয়া তাতে দমে না গিয়ে বদ্ধ দরজা লক্ষ্য করে ১০-১৫টি প্রবল লাথি মারে এবং জোরপূর্বক দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর সে তাসমিন নাহারের ওপর চড়াও হয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করে, যা এক ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি করে।

    পাশের কক্ষে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল তাওসিফ রহমান সুমন। মায়ের আর্তচিৎকার ও ধস্তাধস্তির বিকট শব্দে সে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। বাসার কাজের মেয়েটি তাকে এই ভয়াবহ ঘটনার বিষয়ে জানায়। কর্তব্যপরায়ণ সুমন তাৎক্ষণিকভাবে ওই কক্ষে ছুটে যায় এবং মাকে ঘাতকের হাত থেকে বাঁচাতে লিমন মিয়াকে প্রতিরোধ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই প্রতিরোধ করতে গিয়েই সে ঘাতকের ক্রোধের শিকার হয়। পুলিশ ধারণা করছে, ওড়না জাতীয় কোনো নরম বস্তু দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই বীভৎস ঘটনা প্রত্যক্ষ করে কাজের মেয়েটি ভয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়, সম্ভবত সাহায্য চেয়ে বা নিজেদের জীবন বাঁচাতে।

    তদন্তের অগ্রগতি ও ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা

    পুলিশ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখছে। অভিযুক্ত লিমনের সঙ্গে বিচারকের পরিবারের কী ধরনের সম্পর্ক ছিল, কিংবা এই আক্রমণের নেপথ্যে অন্য কোনো গভীর কারণ বিদ্যমান ছিল কিনা, সে বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত চলছে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচার বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট মহলে গভীর শোক ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণও এই বর্বর ঘটনায় স্তম্ভিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুততম সময়ে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here