দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডেঙ্গু এক উদ্বেগজনক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষকে আক্রান্ত করছে এবং কেড়ে নিচ্ছে মূল্যবান প্রাণ। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৯২ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন, যা পরিস্থিতির তীব্রতা আরও প্রকট করে তুলেছে। এই ক্রমবর্ধমান সংখ্যাগুলো জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে আরও কার্যকর ও সুসংহত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি: ২৪ ঘণ্টার চিত্র
শনিবার (১৫ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই সর্বশেষ পরিসংখ্যান জনসম্মুখে আনা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় যারা নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন। এই চিত্র ডেঙ্গুর ব্যাপক ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং এর নিরন্তর চ্যালেঞ্জের দিকে ইঙ্গিত করে।
নতুন আক্রান্ত রোগীর বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণ
একদিনের ব্যবধানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণটি নিম্নরূপ, যা রোগটির স্থানীয় প্রভাব সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দেয়:
- বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
- চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৩৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
- ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১০৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
- রাজধানী ঢাকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনের মধ্যে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (DNCC) সর্বোচ্চ ২২৬ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (DSCC) ১২১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন, যা রাজধানীর ওপর ডেঙ্গুর তীব্র প্রভাব নির্দেশ করে।
- এছাড়াও, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬০ জন এবং সিলেট বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) মাত্র ২ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন।
এই পরিসংখ্যান দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ডেঙ্গুর বিস্তার এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিকে স্পষ্ট করে তোলে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি বোঝা তৈরি করছে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
আরোগ্য লাভ ও চলতি বছরের মোট আক্রান্তের সংখ্যা
আশার কথা এই যে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৮৩ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মোট ৮০ হাজার ২৪৩ জন ডেঙ্গুরোগী সফলভাবে চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র পেয়েছেন, যা চিকিৎসকদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং রোগীদের সুস্থ হয়ে ওঠার একটি ইতিবাচক দিক।
চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৩ হাজার ৮৫৮ জনে। এই আক্রান্তদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণও পাওয়া গেছে: ৬২ দশমিক চার শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ছয় শতাংশ নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যা সংক্রমণের লিঙ্গভিত্তিক তারতম্যকে নির্দেশ করে। এই তথ্য জনসচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হতে পারে।
চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজনিত জটিলতায় আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, যা এই রোগের ভয়াবহতা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়। মৃত এই পাঁচজনই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (DNCC) এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। এই তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এবং জটিলতার হার তুলনামূলকভাবে বেশি। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট ৩৩১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এই ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর সংখ্যা জনমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ, যেমন মশা নিধন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
পূর্ববর্তী বছরগুলোর চিত্র: এক তুলনামূলক বিশ্লেষণ
ডেঙ্গু পরিস্থিতির সামগ্রিকতা অনুধাবনের জন্য পূর্ববর্তী বছরগুলোর তথ্য পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ, যা এই রোগের দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী:
- ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং এই রোগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৫৭৫ জন।
- ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। ঐ বছরে মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং দুঃখজনকভাবে এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়।
এই পরিসংখ্যানগুলি বিগত বছরগুলিতে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা এবং এর ফলে সৃষ্ট জনস্বাস্থ্য সংকটের একটি স্পষ্ট ধারণা দেয়। চলতি বছরের পরিস্থিতি যদিও গত বছরের চেয়ে কিছুটা কম তীব্র মনে হলেও, নতুন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা এখনও জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে বিদ্যমান। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়মিত মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা এবং আক্রান্তদের দ্রুততম সময়ে সঠিক চিকিৎসার আওতায় আনা অপরিহার্য। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সতর্কতাই কেবল এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে।
