বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান সম্প্রতি এক বিস্ফোরক মন্তব্যে জামায়াত ইসলামীর আদর্শের সাথে নিজের ইসলামি বিশ্বাসের মৌলিক পার্থক্যের কথা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। যুগান্তরে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি জামায়াতের ইসলামকে “ইসলাম ধর্মের বিরোধী” আখ্যায়িত করে তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনা করেছেন, যা দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ইসলামের মর্মার্থ নিয়ে ফজলুর রহমানের ভিন্ন মত
অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “জামায়াতের ইসলাম আর আমার ইসলাম এক না।” তার মতে, ইসলামের প্রকৃত মর্ম নিহিত রয়েছে সুফিবাদী বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিকতার গভীরে। তিনি নিজেকে সেই সুফিবাদী মানুষের উত্তরসূরি হিসেবে দাবি করেন, যারা শত শত বছর ধরে এই ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন প্রেম ও সহানুভূতির মাধ্যমে। তার ভাষায়, এটি ছিল একটি প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী ধারা। এর বিপরীতে তিনি জামায়াতকে ‘ওহাবী’ মতাদর্শের অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করেন, যেখানে নবীজিকে ‘আমাদের বড় ভাই লাগে’ বলে সম্বোধন করা হয়, যা তার কাছে নবুওয়াতের মর্যাদাহানিকর এবং ইসলামবিরোধী এক বিকৃত ব্যাখ্যা। ফজলুর রহমানের গভীর বিশ্বাস, যদি কোনো ধর্মের আধ্যাত্মিক দিক না থাকে, তবে তা পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হতে পারে না; কেবল বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব হয়ে পড়ে।
জামায়াতের আমীরের অতীত ও বর্তমান পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন
বিএনপির এই নেতা জামায়াতে ইসলামীর আমীরের রাজনৈতিক যাত্রাপথ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস পরিবর্তনের বিষয়েও তীব্র কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, জামায়াত আমিরের চেহারায় তার দাদার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেও, বয়সে তিনি ১০ বছরের ছোট। ফজলুর রহমান সরাসরি জামায়াতের আমীরকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমি তো বলি, বসেন আমার সঙ্গে।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, যিনি একসময় জাসদের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে ধর্মবিশ্বাসের ধার ধারতেন না, তিনি কীভাবে হঠাৎ করে আসমান থেকে নেমে আসা একজন “আমিরে জামায়াত” হয়ে ধর্মের তথাকথিত “খাদেমদার” হয়ে উঠলেন? ফজলুর রহমান চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, “আপনি যে ধর্মটা জামায়াতের নামে প্রচার করেন সেটা কী ধরনের ধর্ম, দেখি আপনি বসেন আমার সঙ্গে।” এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং জামায়াতের আদর্শিক ভিত্তি এবং তাদের নেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এক মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন।
মারেফাত ও তরিকতের অপরিহার্যতা এবং নবীর মর্যাদা
ইসলামের গভীরতর জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক সাধনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান মন্তব্য করেন, মারেফাত (তত্ত্বজ্ঞান) ও তরিকত (আধ্যাত্মিক পথ) ছাড়া ইসলাম ধর্ম কীভাবে পূর্ণাঙ্গ হতে পারে? তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন যে, জামায়াত এই মারেফাত ও তরিকতকে স্বীকার করে না, যা তাদের ইসলামি ধারণাকে একপেশে করে তোলে। শরীয়তের সুস্পষ্ট বিধানগুলো— যেমন কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত— অপরিহার্য হলেও, ফজলুর রহমান জোর দেন যে, এর সাথে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অতুলনীয় মর্যাদা ও অলৌকিকত্বে বিশ্বাস স্থাপনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দাবি করেন, বিশ্বাস করতে হবে যে, নবীজি বোরাকে আরোহণ করে মিরাজে গিয়েছিলেন, তিনি ‘খাতিমুন্নবী’ অর্থাৎ পৃথিবীর সর্বশেষ নবী এবং ‘নূরের নবী’। এই বিশ্বাসকে মৌলিক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, যদি কেউ নবীজিকে ‘আমাদের মতই মানুষ’ বলে মনে করে, তবে তা সম্পূর্ণ ভুল এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী। তার মতে, নবীর ওপর কোরআন নাজিল হয়েছে, যা তাকে অন্য সকল মানব থেকে পৃথক ও অনন্য করে তোলে। ফজলুর রহমান জামায়াতের ইসলামকে “সূরা নুরুল ইসলাম” হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তার নিজের ইসলামকে “হযরত মুহাম্মদ (সা.)” এর আদর্শে প্রতিষ্ঠিত বলে ঘোষণা করেন, যা দুটি ধারার মধ্যে গভীর বিভাজনকে নির্দেশ করে।
পীর-আউলিয়ার আশীর্বাদ এবং ধর্মীয় বৈধতা
নিজেকে আধ্যাত্মিকভাবে বলীয়ান প্রমাণ করতে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান তার ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক প্রাপ্তির কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তাকে পীর-আউলিয়া, কুতুব ও দরবেশদের দোয়া দিয়েছেন। বিশেষভাবে তিনি হযরত শাহজালাল (রহ.) এবং শাহপরান (রহ.)-এর মতো মহান সুফি সাধকদের দোয়ার কথা উল্লেখ করে নিজের ধর্মীয় অবস্থানের বৈধতা এবং গভীরতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। এই আত্ম-ঘোষণা তার ইসলামি বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করে এবং জামায়াতের তুলনামূলকভাবে শুষ্ক ও আক্ষরিক ব্যাখ্যা থেকে তার অবস্থানকে পৃথক করে তোলে। এটি তার বক্তব্যের প্রতি এক প্রকার আধ্যাত্মিক অনুমোদন যোগ করে, যা তার সমালোচনাকে আরও ওজনদার করে তোলে।
