ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার অবিরাম প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও নৌ সহযোগিতা আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে পাঁচ দিনের শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে আগমন করেছে রুশ নৌবাহিনীর অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ ‘গ্রিমিয়াশ্চি’। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন এই জাহাজটির আগমন দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং সামরিক আদান-প্রদানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে উভয় দেশের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।
বর্ণাঢ্য অভ্যর্থনা ও আনুষ্ঠানিকতা
সোমবার, এক বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে, যেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রুশ নৌ সদস্যদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। এ সময় চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চলের চিফ স্টাফ অফিসার জাহাজের কর্মকর্তা ও নাবিকদের সাদর সম্ভাষণ জানান। ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের স্মারক হিসেবে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সুসজ্জিত বাদক দল মনোমুগ্ধকর ব্যান্ড পরিবেশনার মাধ্যমে রুশ নৌ সদস্যদের স্বাগত জানায়, যা সামরিক প্রথা এবং আতিথেয়তার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার মিলিটারি অ্যাটাচেসহ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর স্থানীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, যা এই সফরের কূটনৈতিক গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
প্রাথমিক অভ্যর্থনা ও আইএসপিআর-এর ঘোষণা
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সোমবার এসব তথ্য বিস্তারিতভাবে নিশ্চিত করেছে। আইএসপিআর আরও জানায় যে, বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের পরপরই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘বানৌজা ওমর ফারুক’ রুশ জাহাজটিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় এবং প্রথাগতভাবে পথপ্রদর্শক হিসেবে বন্দর পর্যন্ত নিয়ে আসে। এই প্রথাগত অভ্যর্থনা দুই নৌবাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান পেশাদারিত্ব, সুসম্পর্ক ও প্রটোকলের সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যা ভবিষ্যতে আরও গভীর সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করবে।
গুরুত্বপূর্ণ সৌজন্য সাক্ষাৎ ও কূটনৈতিক বিনিময়
বাংলাদেশে অবস্থানকালে ‘গ্রিমিয়াশ্চি’ জাহাজের সুযোগ্য অধিনায়ক এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার মিলিটারি অ্যাটাচের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতসূচির মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চলের কমান্ডার, বিএন ফ্রিটের কমান্ডার, ডকইয়ার্ডের এরিয়া সুপারিনটেনডেন্ট এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। এই সৌজন্য সাক্ষাৎগুলো দুই দেশের নৌ বাহিনীর মধ্যে কৌশলগত আলোচনা, অভিজ্ঞতা বিনিময়, সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সফরসূচি ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান
সফরকারী রুশ নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও নাবিকদের জন্য একটি বিস্তারিত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কার্যক্রম পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা দুই দেশের সাংস্কৃতিক ও পেশাগত বোঝাপড়াকে আরও উন্নত করবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে অবস্থিত রেডকিন পয়েন্টে পুষ্পস্তক অর্পণ, যা জাতির বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের প্রতীক। এছাড়া তারা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিভিন্ন জাহাজ, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য পরিচালিত ‘বিএন আশার আলো স্কুল’ পরিদর্শন করবেন, যা নৌবাহিনীর সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানবিক কার্যক্রমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চট্টগ্রামের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে রুশ প্রতিনিধিদল শহরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনাসমূহ ঘুরে দেখবেন। এই সফর কেবল সামরিক আদান-প্রদানে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং এটি দুই দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধনকেও সুদৃঢ় করবে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরাও রুশ যুদ্ধজাহাজ ‘গ্রিমিয়াশ্চি’ পরিদর্শনের সুযোগ পাবেন, যা তাদের আধুনিক নৌ প্রযুক্তি ও অপারেশনাল সক্ষমতা সম্পর্কে মূল্যবান ধারণা দেবে।
সফরের তাৎপর্য এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্ক
এই শুভেচ্ছা সফর বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। এই সফরের মাধ্যমে দুই দেশের নৌবাহিনীর সদস্যরা পারস্পরিক কার্যক্রম, উন্নত প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং পেশাগত উৎকর্ষ প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবেন। এর ফলে উভয় দেশের নৌ সেনাদের মধ্যে পেশাগত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বিনিময়ের পথ সুগম হবে, যা তাদের নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। অতীতেও রাশিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজ বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে এসেছে, যা দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করে। এই সফর আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি দুই দেশের যৌথ অঙ্গীকারের প্রতিফলন এবং ভবিষ্যতের আরও ফলপ্রসূ সহযোগিতার ইঙ্গিত বহন করে।
