আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তখন যশোর জেলার ছয়টি সংসদীয় আসন নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এই আসনগুলোতে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও দলগুলোর কৌশল নিয়ে রাজনৈতিক মহল সরব। বিশেষ করে, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যশোর জেলার মোট ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে তাদের দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলেও, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে চারজনের ক্ষেত্রেই স্থানীয় পর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে লিখিতভাবে প্রার্থী পরিবর্তনের আবেদন জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঐক্য বজায় রেখে আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দলটির নেতৃত্ব কতটা সফল হয়, তার ওপরই নির্ভর করবে তাদের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ও ঐক্যের আহ্বান
যশোরে বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর যে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, তা মোকাবিলায় দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বেশ সতর্ক। বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম (অমিত) অবশ্য এই পরিস্থিতিকে দলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণা হলে দলের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ থাকবে না। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “বিএনপি একটি বৃহৎ এবং সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিকভাবেই এই দলে প্রতিটি সংসদীয় আসনে একাধিক যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থী রয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে সবারই মনোনয়ন দাবি করা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয়।”
অমিত আরও জানান, চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক পরিসরে বর্ধিত সভার আয়োজন করা হবে। এসব সভার মূল উদ্দেশ্য থাকবে দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ধানের শীষ প্রতীকের বিজয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ করা। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলের মধ্যে বিদ্যমান সকল ভুল বোঝাবুঝি ও মতপার্থক্য দূর হয়ে যাবে এবং নির্বাচনী মাঠে কোথাও কোনো বিরোধের রেশ থাকবে না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনায় দলীয় ঐক্য সুসংহত করে নির্বাচনী লড়াইয়ে পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। এই উদ্যোগগুলো কতটা সফল হয়, তার ওপরই নির্ভর করবে যশোরের আসনগুলোতে বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্বাচনী ফলাফল। নেতৃত্বের এই আত্মবিশ্বাস দলের ভেতরে কতটা প্রতিফলিত হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
জামায়াতের স্বতন্ত্র কৌশল ও পরিবর্তনের স্লোগান
একদিকে যখন বিএনপি নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যশোর জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনেই নিজেদের দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে রীতিমতো আগাম নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েছে। এই তৎপরতা জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং অন্যান্য দলগুলোর ওপরও এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জেলা জামায়াতের আমির মো. গোলাম রসুল দৃঢ়তার সাথে মন্তব্য করেছেন যে, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী ফলাফলের নিরিখে ২০২৪ সালের জামায়াতকে বিচার করা ঠিক হবে না। তাঁর মতে, গত তিন দশকে দেশের মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
গোলাম রসুল আরও বলেন, “বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এখন পরিবর্তন ও নতুনত্বের সন্ধানে রয়েছে। তারা গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে এসে একটি কার্যকর ও কল্যাণমুখী পরিবর্তন দেখতে চায়।” জামায়াত এই তরুণ সমাজের আকাঙ্ক্ষাকেই পুঁজি করে নির্বাচনী মাঠে নেমেছে এবং পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছে। এই কৌশল কতটা ফলপ্রসূ হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলের দিন পর্যন্ত। জামায়াতের এই আগাম প্রচারণা ও পরিবর্তনের স্লোগান অন্যান্য দলগুলোর ওপরও এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের এই স্বাধীন প্রচারণা জেলার রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি
যশোরের নির্বাচনী মাঠে কেবল প্রধান দুই ধারার রাজনৈতিক দলই নয়, অন্যান্য ছোট ও আঞ্চলিক দলগুলোও নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো তাদের দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করলেও, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ইতোমধ্যে নিজেদের মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করেছে। এই দুটি ইসলামী ধারার দলের প্রার্থীরাও কমবেশি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন এবং ভোটারদের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
যদিও তাদের প্রচারাভিযান এখনো বড় আকার ধারণ করেনি, তবুও তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কিছু জনভিত্তি রয়েছে, যা নির্বাচনের ফলাফলে আংশিক প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। এই দলগুলোর প্রার্থীরা মূলত ধর্মপ্রাণ ভোটারদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন, এবং তাদের উপস্থিতি নির্বাচনের বহুমাত্রিকতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। তাদের প্রচারণার ধরণ ও কৌশল মূলধারার দলগুলো থেকে ভিন্ন হলেও, স্থানীয় পর্যায়ে তারা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
যশোরের নির্বাচনী ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
যশোরের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ বুঝতে এর বিগত নির্বাচনী ফলাফলগুলো বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিগত সাধারণ নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, জেলার আসনগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এটি বোঝায় যে, যশোরের ভোটাররা বরাবরই বেশ সচেতন এবং তাদের সিদ্ধান্ত বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে।
- ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন: এই নির্বাচনে যশোর জেলার মোট ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পাঁচটি আসনে জয়লাভ করে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেয়। অপরদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি আসনে জয়ী হয়ে তাদের নির্বাচনী শক্তি প্রদর্শন করে। এই ফলাফল জেলার রাজনীতিতে উভয় দলের গুরুত্ব তুলে ধরে।
- ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচন: এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দেখা যায়। জেলার সব কটি অর্থাৎ, ছয়টি আসনেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে নিজেদের ক্ষমতা সুদৃঢ় করে। এটি ছিল আওয়ামী লীগের জন্য এক ঐতিহাসিক সাফল্য, যা জেলার রাজনৈতিক মানচিত্রে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে তোলে এবং তাদের জনসমর্থনের গভীরতা প্রমাণ করে।
- ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন: এই নির্বাচনটি ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং একাধিক দলের মধ্যে আসন ভাগাভাগি হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি দুটি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি (নাজিউর) এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রত্যেকে একটি করে আসনে জয়ী হয়। এই ফলাফল প্রমাণ করে যে, যশোর জেলার ভোটাররা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের আস্থা প্রকাশ করেছেন এবং এখানে একক দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখা সর্বদা সম্ভব হয়নি।
- ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচন: (মূল তথ্যসূত্র অনুযায়ী, এই নির্বাচনের বিস্তারিত ফলাফল অসম্পূর্ণ থাকায় পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব হয়নি। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ছিল, যেখানে অনেক আসনে নতুন মেরুকরণ দেখা গিয়েছিল এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছিল।)
এই ঐতিহাসিক তথ্যগুলো থেকে বোঝা যায়, যশোর বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পরিবর্তনশীল নির্বাচনী এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এখানে কোনো একক দলের স্থায়ী আধিপত্য বজায় রাখা সবসময়ই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। বর্তমান নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এই অতীত ফলাফলগুলো দলগুলোর কৌশল নির্ধারণে এবং ভোটারদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এবারের নির্বাচনেও যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, তা বলা বাহুল্য।
