More

    তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ১৩ বছর : ‘আমরা ক্ষতিপূরণ চাই, মালিকের শাস্তি চাই’

    আজ থেকে ঠিক তেরো বছর আগে, ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বরের এক সন্ধ্যায়, সাভারের আশুলিয়া অঞ্চলের নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের কারখানায় ঘটেছিল এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। সেই কালো অধ্যায়ের স্মৃতিচারণায়, যখন রাষ্ট্র ও সমাজ আগুনের ক্ষত ভুলতে চাইছে, তখনো কিছু মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দিনের বিভীষিকার শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। এই ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার ১৩ বছর পূর্তিতে ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফের সরব হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা। এর জ্বলন্ত প্রমাণ আজ সকালে দেখা গেল তাজরীনের পরিত্যক্ত ভবনের সামনে, যেখানে খোলা আকাশের নিচে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন অগ্নিকাণ্ডের পাঁচজন আহত নারী শ্রমিক। তাদের এই অবস্থান নীরব প্রতিবাদেরই এক প্রতিচ্ছবি, যা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ন্যায়বিচারের জন্য তাদের অপেক্ষার করুন গাথা তুলে ধরছে।

    ন্যায়বিচারের দাবিতে ১৩ বছর পর

    সকাল আনুমানিক সাড়ে ছয়টায় তাজরীন ফ্যাশনসের সেই ৮ তলা ভবনের সামনে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে। দ্বিতীয় তলার ফটকে ঝুলছে তালা, আর ভেতর দেয়াল ও ছাদের পোড়া দাগগুলো যেনো সেদিনকার আগুনের ভয়াবহতাকে এখনো মূর্ত করে রেখেছে। বিভিন্ন তলার ভাঙা জানালাগুলোও সাক্ষ্য দিচ্ছে সেই দিনের বিয়োগান্তক ঘটনার। এই পোড়া ক্ষতচিহ্নকে পেছনে ফেলেই, পাটি বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে ছিলেন বিভিন্ন বয়সী পাঁচ নারী। তাদের জড়ো হওয়ার মূল উদ্দেশ্য নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, একইসাথে নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

    সেই পাঁচ নারীর মধ্যে অন্যতম নাটা বেগম, যিনি এসেছিলেন সুদূর গোপালগঞ্জ থেকে। তিনি জানালেন তার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। “গতকাল রাতেই গোপালগঞ্জ থেকে এসেছি। তাজরীনের তিনতলায় বুয়ার কাজ করতাম। সেদিন জানালা দিয়ে লাফিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলাম। আমাদের অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে,” দৃঢ় কণ্ঠে তিনি তার দাবি তুলে ধরেন। তার কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে বয়ে বেড়ানো শারীরিক আঘাত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হতাশা।

    উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় সংঘটিত এই মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন নিরীহ পোশাকশ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান এবং আহত হন অসংখ্য শ্রমিক। এই ঘটনা দেশের পোশাকশিল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছিল এবং আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। সেই থেকে শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলো, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও নিহতদের স্বজনেরা এই ঘটনায় জড়িতদের বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে আসছেন।

    প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি ও অক্ষত ক্ষতের চিহ্ন

    ভবনের সামনে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকা রংপুরের মাহমুদা বেগম (৪০) তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। “ওই দিন সন্ধ্যায় আগুন লাগল। যখনই অ্যালার্ম বাজছিল, আমরা দৌড়ে নিচে নামছিলাম। তিনতলা পর্যন্ত নামতে পেরেছিলাম, কিন্তু দেখি গেটে তালা মারা। বাইরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। তারপর গ্লাস রুমের (কাঁচের কক্ষ) দিকে দৌড়ে গেলাম। দেখি মানুষ লাফিয়ে বাইরে বের হচ্ছে। আমিও বের হতে গিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলাম। মাথায় আর কাঁধে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলাম,” মাহমুদা বেগমের কণ্ঠে তখনো সেই দিনের ভয়াল স্মৃতি স্পষ্ট। তার এই বর্ণনা কেবল একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, বরং অসংখ্য শ্রমিকের আটকে পড়া ও বাঁচার শেষ চেষ্টাগুলোর এক প্রতিচ্ছবি।

    আজকের এই দিনে, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মী, নিহত শ্রমিকদের স্বজন এবং আহত শ্রমিকেরা ভবনটির সামনে জড়ো হয়েছেন নিহত শ্রমিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে। তাদের সম্মিলিত উপস্থিতি একদিকে যেমন বিগত বছরগুলোর নীরব প্রতিবাদকে নতুন করে জাগিয়ে তুলছে, তেমনই তা রাষ্ট্র ও শিল্পের প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা বহন করছে – শ্রমিকদের জীবন ও নিরাপত্তা কখনোই অবহেলার বিষয় হতে পারে না। এই আহত শ্রমিকদের অবিরাম সংগ্রাম স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here