More

    ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’

    ফুটবল বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়ে ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর চিরবিদায় নিয়েছিলেন ফুটবলের অবিসংবাদিত জাদুকর ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। তার মহাপ্রয়াণের পঞ্চমবার্ষিকীতে, কিংবদন্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রথম আলোতে প্রকাশিত উৎপল শুভ্রর সেই মর্মস্পর্শী রচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো, যা তার প্রস্থানের অব্যবহিত পরেই পাঠকের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলেছিল। এই লেখার মধ্য দিয়ে আমরা আবারও ডুব দেব সেই কালজয়ী ফুটবলারের স্মৃতিচারণায়, যিনি তার জাদুকরি প্রতিভা দিয়ে জয় করেছিলেন কোটি কোটি মানুষের মন।

    ফুটবল ইতিহাসের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র, পেলে, তার প্রিয় ‘বন্ধু’ ম্যারাডোনার সঙ্গে স্বর্গলোকে ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রশ্ন জাগে, ডিয়েগো কি সেই অলৌকিক মুহূর্তের অপেক্ষায় আছেন? নাকি অজানা সেই রহস্যময় জগতে তিনি ইতিমধ্যেই তার অনবদ্য বল কারিকুরি দিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন, যেখানে কালের সীমানা পেরিয়ে ফুটবল তার শাশ্বত রূপ ধারণ করেছে?

    চোখ বুজলেই যে চিত্রটি মানসপটে ভেসে ওঠে, তা হলো ম্যারাডোনা – কখনো তার আকাশচুম্বী মাথার উপর বল নাচছে, কখনো বা সেই বিখ্যাত বাঁ পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করছেন ফুটবলপ্রেমীদের। আহ, তার সেই অতুলনীয় বাঁ পা, যা ফুটবলকে দিয়েছিল এক নতুন সংজ্ঞা, সৃষ্টি করেছিল অসংখ্য অবিস্মরণীয় মুহূর্ত! তার খেলা ছাড়ার পর কেটে গেছে বহু বছর, কিন্তু সেই বাঁ পায়ের অনিন্দ্য সুন্দর কারুকাজ এখনো তরতাজা হয়ে আছে স্মৃতিতে, যেন সেদিনের ঘটনা।

    খেলার মাঠ ছাড়ার বহু বছর পরেও ম্যারাডোনা ছিলেন সংবাদের শিরোনামে। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, এমনকি কখনো কখনো তার বিতর্কিত কার্যকলাপও তাকে প্রতিনিয়ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিল। এমন কোনো দিন হয়তো খুঁজে পাওয়া কঠিন, যখন ম্যারাডোনা কোথাও গেছেন এবং কোনো আলোচনা বা বিতর্কের জন্ম দেননি। বিতর্ক, সমালোচনা, ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন—সবকিছু ছাপিয়েও অগণিত ভক্তের হৃদয়ে ম্যারাডোনার যে ছবি অমলিন, তা হলো ফুটবল পায়ে এক অপ্রতিরোধ্য শিল্পী। এমনকি যারা তাকে সরাসরি খেলতে দেখেননি, তাদের মনেও ম্যারাডোনার এই ফুটবলীয় সত্তা এক চিরন্তন ছাপ ফেলে গেছে, যা সত্যিই বিস্ময়কর।

    ফুটবলের জাদুকরি বাঁ পা: এক উত্তরাধিকার

    ফুটবল ইতিহাসের পাতায় যখনই ‘বিখ্যাত বাঁ পা’র কথা আসে, সর্বপ্রথম যে নামটি ভেসে ওঠে, তা হলো হাঙ্গেরীয় কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক পুসকাস। ‘ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স’ নামে পরিচিত পাঁচের দশকের সেই অনবদ্য হাঙ্গেরি দলের প্রাণভোমরা ছিলেন তিনি। ‘দ্য গ্যালোপিং মেজর’ হিসেবে পরিচিত পুসকাসের ৮৫ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৮৪ গোলের বিস্ময়কর রেকর্ড আজও ফুটবলপ্রেমীদের স্তম্ভিত করে, তার অসামান্য প্রতিভা ও গোল করার ক্ষমতাকে প্রমাণ করে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, ফুটবল ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী শিখরে পৌঁছেও বিশ্বকাপ জয়ের সোনালি ট্রফি তার অধরা ছিল – এক অমোচনীয় দীর্ঘশ্বাস তার ক্যারিয়ারের অন্যতম ট্র্যাজিক অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে।

    আধুনিক ফুটবলের আরেক জাদুকর, লিওনেল মেসিকেও তার বাঁ পায়ের অসামান্য কারুকার্য সত্ত্বেও দীর্ঘশ্বাস পোড়াতে হয়েছিল বিশ্বকাপের জন্য (পরবর্তী বিশ্বকাপেই অবশ্য তিনি এই দীর্ঘশ্বাসকে জয় করে অবশেষে বিশ্বকাপ হাতে তুলেছেন, যা তার শ্রেষ্ঠত্বকে পূর্ণতা দিয়েছে)। কিন্তু এই মাপকাঠিতেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার বাঁ পা হয়ে ওঠে এক অনন্যসাধারণ সত্তা, একমেবাদ্বিতীয়ম। একজন ফুটবলারের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের চূড়ান্ত মানদণ্ড, বিশ্বকাপ, সেখানেই ম্যারাডোনা দেখা দিয়েছেন তার পরিপূর্ণ মহিমায়, একাই প্রায় গোটা দলকে কাঁধে তুলে এনেছিলেন সাফল্যের শিখরে। তার বাঁ পায়ের জাদুতেই আর্জেন্টিনা ছিনিয়ে এনেছিল বিশ্বকাপ, যা তাকে ফুটবল ইতিহাসের এক বিরল আসনে বসিয়েছে। এক অর্থে, এই অর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি পেলের সমকক্ষ এক অনবদ্য কিংবদন্তি হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, যার তুলনা কেবল তিনি নিজেই।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here