বাংলাদেশে ক্রনিক কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) বা দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের একটি বিরাট অংশ চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। ঔষধপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য তাদের জীবনে আর্থিক বিপর্যয়ের এক নতুন অধ্যায় যোগ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন এক সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে অনেক রোগীর জন্য বিনামূল্যে কিডনি রোগের ঔষধ সরবরাহ করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ঔষধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির প্রতি জোরালো আহ্বান জানানো হয়েছে যাতে তারা সাশ্রয়ী মূল্যে কিডনি রোগের ঔষধ উৎপাদন করে। বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ঔষধের সহজলভ্যতা দরিদ্র রোগীদের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে এবং তাদের অর্থনৈতিক বোঝা লাঘব করতে পারে।
কিডনি রোগের আর্থিক বোঝা: বিশেষজ্ঞদের গভীর উদ্বেগ
সম্প্রতি, রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (নিকডু) হাসপাতালের মিলনায়তনে আয়োজিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সেমিনারে দেশের শীর্ষস্থানীয় কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা এই গভীর উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। ঔষধের উচ্চমূল্যের কারণে রোগীদের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের মুখে পড়ার বিষয়টি তাদের আলোচনায় প্রধান্য পায়। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, কিডনি রোগীরা যাতে কম দামে ঔষধ কিনতে পারেন, সেজন্য ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এটি কেবল একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়, বরং একটি গুরুতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এই বৈজ্ঞানিক সেমিনারটি বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন এবং নিকডু যৌথভাবে আয়োজন করে, যা ডেল্টা ফার্মা লিমিটেড-এর সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হয়। এই আয়োজনটি দেশের কিডনি রোগ চিকিৎসা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে বিশেষজ্ঞগণ রোগীদের চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরে নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কার্যকর সুপারিশমালা পেশ করেন। মূলত, সমাজের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের রোগীদের জীবনমান উন্নয়নে ঔষধের সহজলভ্যতা ও সাশ্রয়ী মূল্যের গুরুত্ব অপরিহার্য, এমনটাই মত দেন আলোচকরা।
বিশিষ্টজনের উপস্থিতি ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
সেমিনারটি বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে আলোচনার মূল সুর বাঁধা হয়, যেখানে রোগীরা যে ভয়াবহ আর্থিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। তিনি উল্লেখ করেন, জীবনরক্ষাকারী ঔষধের উচ্চমূল্য দেশের স্বাস্থ্যসেবার সার্বজনীনতা এবং সকলের জন্য সমান অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নিকডুর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং কিডনি ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. মো. হারুন অন রশীদ। তাঁর বক্তব্যে তিনি কিডনি রোগের চিকিৎসা সকলের জন্য সহজলভ্য করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং এই বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি আরও বলেন, রোগকে প্রতিরোধ করা এবং চিকিৎসার ব্যয়ভার কমানো উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ অতিথি হিসেবে সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউসুফ, বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার রায় এবং অধ্যাপক ডা. আইয়ুব আলী চৌধুরী। তাদের প্রত্যেকেই কিডনি রোগের ভয়াবহতা এবং রোগীদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে মূল্যবান মতামত পেশ করেন। তাঁরা সামাজিক নিরাপত্তা জাল (Social Safety Net) এবং সরকারি ভর্তুকি ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
এছাড়াও, সেমিনারে বক্তব্য রাখেন নিকডুর বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলফেসানি, সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর কবির, অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ এবং অধ্যাপক ডা. মহিবুর রহমান। তাঁদের সম্মিলিত আলোচনা কিডনি রোগের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ এবং এর টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। বক্তারা ঔষধের দাম কমানো এবং রোগীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা বা সরকারি ভর্তুকি প্রদানের মতো ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করেন, যা দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগের চিকিৎসাকে আরও সহজলভ্য করতে পারে। তাঁরা জোর দেন, শুধুমাত্র চিকিৎসার ব্যয় কমালেই হবে না, বরং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার উপরও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
প্যানেল আলোচনা এবং নতুন ঔষধের উন্মোচন
সেমিনারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল দুটি প্যানেল আলোচনা। প্রথম প্যানেলে কিডনি রোগীদের মধ্যে হার্ট ফেইলর-এর ঝুঁকি এবং এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়, যা কিডনি রোগের অন্যতম গুরুতর জটিলতা। কিডনি ও হৃদরোগের আন্তঃসম্পর্ক এবং এর সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতির উপর বিশেষজ্ঞগণ গুরুত্বারোপ করেন। দ্বিতীয় প্যানেলটি কিডনি রোগের চিকিৎসায় এমআরএ (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স অ্যাঞ্জিওগ্রাফি)-এর গুরুত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে আলোকপাত করে। এই আলোচনাগুলি আধুনিক কিডনি চিকিৎসা পদ্ধতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এবং উপস্থিত চিকিৎসক ও গবেষকদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। এর মাধ্যমে উন্নত রোগ নির্ণয় পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা এবং তার প্রয়োগিক দিকগুলো স্পষ্ট হয়।
অনুষ্ঠানে ডেল্টা ফার্মা কর্তৃক উৎপাদিত একটি নতুন ঔষধ – ফেনেরেনন (যার বাণিজ্যিক নাম ফিনফিক্স) – এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা এই ঔষধটির উন্মোচন করেন, যা ক্রনিক কিডনি ডিজিজেস রোগীদের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ধরনের নতুন ও কার্যকর ঔষধের সহজলভ্যতা রোগীদের জন্য অত্যাবশ্যক, তবে এর দাম যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সে বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এই ঔষধটি রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাদের বক্তব্যে পুনরায়强调 করেন যে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে রোগীদের সামর্থ্যের অভাবে প্রায়শই উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ সম্ভব হয় না। এই আর্থিক সীমাবদ্ধতা বহু রোগীকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় এবং পরিবারকে দরিদ্রতার গভীর খাদে নিক্ষেপ করে। তাই, ঔষধের দাম কমানো এবং চিকিৎসা সেবাকে সকলের জন্য সুলভ করার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ঔষধ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে লক্ষ লক্ষ কিডনি রোগী নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারবেন এবং সমাজের উপর থেকে অসুস্থতার বোঝা অনেকটাই লাঘব হবে। এই সেমিনারের মাধ্যমে নীতি নির্ধারকদের কাছে একটি জোরালো বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে – কিডনি রোগ চিকিৎসায় affordability এবং accessibility এখন জাতীয় জনস্বাস্থ্য এজেন্ডার শীর্ষে থাকা উচিত এবং এটি নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য।
