রাজধানী ঢাকার খুচরা বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি বরাবরই সাধারণ মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে মুরগি ও মাছের দামে একটি আপাত স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও, সাধারণ ক্রেতাদের জন্য তা কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি বয়ে আনতে পারেনি। দেশের খুচরা বাজারে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তালিকা অপরিবর্তিত থাকলেও, কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, যা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
মূল্য স্থিতিশীলতার আড়ালে অস্বস্তি: ঢাকার বাজার পরিস্থিতি
বিক্রেতাদের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহের তুলনায় ব্রয়লার মুরগির দামে সামান্য হ্রাস পরিলক্ষিত হলেও, দেশি মুরগি এবং অন্যান্য প্রকারের মাছের মূল্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। এর ফলস্বরূপ, সামগ্রিক বাজার এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে রয়ে গেছে, যা দৈনন্দিন বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। বিশেষ করে, সীমিত ও মধ্যম আয়ের মানুষজন তাদের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন, এবং বাজারের এই প্রবণতা তাদের জন্য একরকম নতুন অর্থনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে।
নির্দিষ্ট পণ্যের বর্তমান বাজারমূল্য
গত শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, রাজধানীর উত্তরা এলাকার আজমপুর কাঁচাবাজার এবং মালিবাগ-বাড্ডা অঞ্চলের বিভিন্ন বাজার সরেজমিনে পরিদর্শন করে বর্তমান বাজারমূল্যের একটি বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। বর্তমানে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৭০-১৮০ টাকা, লেয়ার মুরগি ৩১০ টাকা, সোনালি মুরগি ২৮০ টাকা এবং পাকিস্তানি মুরগি ৩২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে, দেশি মুরগির দাম আকাশছোঁয়া, প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা সাধারণের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে। এছাড়া, দেশি পাতিহাঁস প্রতি কেজি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এই মূল্য তালিকা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, তুলনামূলকভাবে কম দামের ব্রয়লার ব্যতীত অন্য কোনো মুরগি কেনা সাধারণ মধ্যবিত্তের জন্য একরকম বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিক্রেতাদের দৃষ্টিকোণ: ব্রয়লারের দাম কমার কারণ ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জ
বাজার বিক্রেতারা জানিয়েছেন যে, ব্রয়লার মুরগির পাইকারি মূল্যে কিছুটা নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাওয়ায় খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। তবে, দেশি ও সোনালি মুরগির দাম দীর্ঘকাল ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে, যা উৎপাদন খরচ এবং সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতার ইঙ্গিত দেয়। আজমপুর বাজারের একজন অভিজ্ঞ বিক্রেতা, জনাব রফিক, জানান, “গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির পাইকারি দাম প্রতি কেজি ১৮০ টাকার উপরে ছিল। বর্তমানে তা কমে ১৫৫–১৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যার ফলস্বরূপ আমরা খুচরা বাজারে ১৭০ টাকায় বিক্রি করতে পারছি।” তিনি আরও যোগ করেন, “তবে, পশুখাদ্যের মূল্য এবং পরিবহন খরচ না কমা পর্যন্ত মুরগির দাম আরও কমার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।” খিলক্ষেত বাজারের বিক্রেতা এ.আর. রহমান বলেন, “দেশি এবং সোনালি মুরগির দাম বেশ কিছুদিন ধরেই একই জায়গায় আটকে আছে। এর ফলে, তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হওয়ায় এখন ক্রেতারা ব্রয়লার মুরগির দিকেই বেশি ঝুঁকছেন।” এই চিত্র বাজার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে – যেখানে উচ্চ উৎপাদন খরচ ও সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়।
ভোক্তাদের সীমাবদ্ধতা: ব্রয়লারই একমাত্র ভরসা
বাজার করতে আসা ক্রেতারা তাদের সীমাবদ্ধতার কথা স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রেতা আক্ষেপ করে বলেন, “অতিরিক্ত দামের কারণে এখন ব্রয়লার মুরগিতেই ভরসা রাখতে হচ্ছে। ব্রয়লার ছাড়া অন্য কোনো সোনালি কিংবা পাকিস্তানি ছোট মুরগির দামও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, যা আমাদের মতো সাধারণ পরিবারের পক্ষে বহন করা একরকম অসম্ভব।” এই পরিস্থিতি কেবল প্রোটিনের উৎস পরিবর্তনে বাধ্য করছে না, বরং পারিবারিক পুষ্টি ও খাদ্য পরিকল্পনায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বহু পরিবার এখন আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য কমদামি বিকল্পের দিকে ঝুঁকছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, ঢাকার খুচরা বাজারে মুরগি ও মাছের দামে একটি আপাত স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও, এটি সাধারণ মানুষের পকেটে স্বস্তি আনতে ব্যর্থ। খাদ্যপণ্যের দামের এই ঊর্ধ্বগতি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য একটি গুরুতর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার দ্রুত সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত দ্রুত পশুখাদ্যের দাম ও পরিবহন খরচ নিয়ন্ত্রণে এনে ভোক্তাদের জন্য বাজারকে আরও সহজলভ্য করা এবং সরবরাহ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে পণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা।
