More

    চসিকে হোল্ডিং ট্যাক্স নথি ঘষামাজা করে ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি

    চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) তার সেবাপ্রাপ্তি ও শহরের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে, সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া এক নজিরবিহীন জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনা জনমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ উঠেছে যে, করপোরেশনের একদল অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নথিপত্র বিকৃত ও কৌশলী পরিবর্তনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর) ফাঁকি দিতে সহায়তা করছে, যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সুচতুর প্রতারণার জাল এতটাই বিস্তৃত যে, এর গভীরতা নির্ণয়ে কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হচ্ছে।

    বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি: অভ্যন্তরীণ তদন্তে উন্মোচিত

    সাম্প্রতিক সময়ে চসিকের একটি নিবিড় অভ্যন্তরীণ তদন্তে এ ধরনের দুটি ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে, যা রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তদন্তকারীরা দেখতে পেয়েছেন যে, দুটি পৃথক হোল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে নথিপত্র থেকে অত্যন্ত কৌশলে ‘২’ সংখ্যাটি মুছে ফেলে প্রায় ৪০ কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে দুজন কর কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তিনজন হিসাব সহকারীকে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই দ্রুত পদক্ষেপ করপোরেশনের জিরো টলারেন্স নীতির প্রতিফলন হলেও, এর পেছনের মূল কারণ ও জড়িত অন্যান্যদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া এখনও চলমান।

    দুদকের অভিযান ও নথি জব্দ

    এই নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর পরই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নড়েচড়ে বসে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে টাইগারপাসে অবস্থিত চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে একটি আকস্মিক অভিযান চালায় দুদক। এই অভিযানে সংস্থাটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি ও ফাইল জব্দ করেছে, যা জালিয়াতির তদন্তে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, জব্দকৃত নথিগুলো আরও অনেক অপ্রকাশিত তথ্যের দ্বার উন্মোচন করতে পারে এবং এই দুর্নীতি চক্রের মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে।

    প্রথম জালিয়াতি: এছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড

    সূত্র মারফত জানা গেছে, চসিকের ৮ নম্বর রাজস্ব সার্কেলের আওতাধীন দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহরে অবস্থিত ‘এছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’-এর ২০ কোটি টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক কর মূল্যায়ন নির্ধারিত হয়েছিল ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, এই মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠানটির হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ বই বা ফিল্ডবুকে সাদা ফ্লুইড ব্যবহার করে এবং সুচতুরভাবে ঘষামাজা করে ‘২’ সংখ্যাটি মুছে ফেলা হয়। এর ফলে, ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকার মূল্যায়নকে কৃত্রিমভাবে কমিয়ে মাত্র ৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা দেখানো হয়, যা রাজস্ব বিভাগের চোখে ধুলো দিতে সক্ষম হয়েছিল।

    তদন্ত কমিটি আরও দেখতে পেয়েছে যে, এই বিকৃত ও ঘষামাজা করা ফিল্ডবুকের তথ্যই রিভিউ বোর্ডে উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেই ভুল তথ্যের ভিত্তিতেই কর নির্ধারণ করা হয়। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, এই জালিয়াতিতে শুধুমাত্র মাঠপর্যায়ের কর্মচারীই নয়, বরং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ থাকতে পারে।

    দ্বিতীয় জালিয়াতি: ইন-কন্ট্রেড এবং একই চক্রের পুনরাবৃত্তি

    অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই একই অফিসের, একই ব্যক্তিরা এবং একই রাজস্ব সার্কেলের অধীনে ‘ইন-কন্ট্রেড’ নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। ৫১৫/এ/৬৯৪ হোল্ডিং নম্বরের এই প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক কর মূল্যায়ন নির্ধারিত হয়েছিল ২৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৫০ টাকা। এই বিশাল অঙ্কের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করেই তাদের কর নির্ধারণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবারও সেই অসাধু কর্মকর্তারা পুরনো কৌশল অবলম্বন করে নথিপত্রে ঘষামাজা শুরু করে। ‘২৫’ কোটি টাকার মূল্যায়ন থেকে কৌশলে ‘২’ সংখ্যাটি মুছে ফেলে সেই পরিমাণকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে আনা হয়েছিল, যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য আরও একটি বড় অঙ্কের ক্ষতিসাধন করেছে। এই দুটি ঘটনা প্রমাণ করে যে, এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং চসিকের ভেতরে একটি শক্তিশালী জালিয়াতি চক্র সক্রিয় রয়েছে, যাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা অপরিহার্য। এই ঘটনাগুলো চসিকের আর্থিক স্বচ্ছতা এবং জনসেবার প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here