অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার আইনি প্রক্রিয়া ও বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে এক গভীর স্থবিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেবল আইনি পদক্ষেপেই নয়, বরং তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াতেও উল্লেখযোগ্য মন্থরতা দেখা দিয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পাদিতব্য চুক্তিগুলোও এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে, যা এই জটিল কাজটিকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। লন্ডনে কিছু সম্পদ জব্দ হওয়ার পর এই প্রক্রিয়ায় আর কোনো উল্লেখযোগ্য নতুন অগ্রগতি চোখে পড়ছে না, যা পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার সামগ্রিক কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এই স্থবিরতার পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবরে জানা গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারে নিয়োজিত অন্যতম প্রধান সংস্থা বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর প্রাক্তন প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলাম-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, তার কার্যকালে সংস্থাটির সার্বিক কার্যক্রমে শিথিলতা এসেছিল, যা অর্থ পুনরুদ্ধারের গতিকে মন্থর করে দিয়েছে।
বিতর্কিত পরামর্শক এবং তার ভূমিকা
আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট মহলে আরও একটি চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একজন বিশেষজ্ঞের নিয়োগ প্রক্রিয়া। জানা গেছে, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে উপদেষ্টা পদমর্যাদায় এমন একজন বিশেষজ্ঞকে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছিল। এই বিশেষজ্ঞ, যিনি ইফতি ইসলাম নামে পরিচিত, সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে কাজও করছিলেন। তবে তার নিয়োগের প্রক্রিয়াটি শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল। অভিযোগ ওঠে যে, তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক নিয়োগপত্র ছাড়াই এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন।
গত জুনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদের সভায় তার নিয়োগের প্রস্তাব বাতিল করা হয়। পর্ষদ তার নিয়োগকে অনুমোদন করেনি। ইফতি ইসলাম-এর বিরুদ্ধে বিএফআইইউ-এর স্বাভাবিক কার্যক্রমে অনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছিল। এই অভিযোগ এতটাই গুরুতর ছিল যে, এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ দুজন কর্মকর্তা এই বিষয়ে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। এই ধরনের অভিযোগ নিঃসন্দেহে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের মতো সংবেদনশীল ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
দায়িত্বপ্রাপ্তদের সখ্যতা ও সামগ্রিক স্থবিরতা
শুধু প্রাক্তন বিএফআইইউ প্রধান বা বিতর্কিত পরামর্শকই নন, এই প্রক্রিয়ায় আরও গভীর সমস্যার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহলে এমন গুরুতর অভিযোগও গুঞ্জন আকারে ছড়িয়ে পড়েছে যে, পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের কাজে নিযুক্ত অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের অনৈতিক সখ্যতা গড়ে উঠেছে। যদি এই অভিযোগ সত্য হয়, তবে তা পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এমন সখ্যতা একদিকে যেমন আইনি প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে, অন্যদিকে তথ্য সংগ্রহের পথেও বড় বাধা তৈরি করে।
বিদ্যমান এই জটিল পরিস্থিতিতে পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য গৃহীত বহুমুখী পদক্ষেপ বর্তমানে এক রকম অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। যেখানে রাষ্ট্রের সর্বাত্মক চেষ্টা প্রয়োজন, সেখানে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে শিথিলতা, এই প্রক্রিয়াকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই স্থবিরতা দেশের অর্থনীতি এবং জনগণের আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা দ্রুত নিরসনের জন্য একটি সুসংগঠিত এবং স্বচ্ছ উদ্যোগ একান্ত অপরিহার্য।
