বিশ্বের অন্যতম আলোচিত এবং বিতর্কিত অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর মধ্যে গাজীপুর-বিমানবন্দর বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটি এখন নতুন মোড় নিয়েছে। চরম দীর্ঘসূত্রিতা, অপ্রত্যাশিত ব্যয়বৃদ্ধি এবং মৌলিক পরিকল্পনাগত ত্রুটির কারণে এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে একটি সাধারণ চার লেনের সড়কে পরিণত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটি কেবল একটি প্রকল্পের স্থবিরতা নয়, বরং দেশের বৃহৎ প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক গুরুতর অসঙ্গতি এবং অপচয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা ও আকাশচুম্বী ব্যয়
গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন এই বিআরটি প্রকল্পটি বিশ্বজুড়ে এর ধরনের অন্য যেকোনো প্রকল্পের চেয়ে ছয় গুণ বেশি সময় এবং চার গুণেরও বেশি অতিরিক্ত খরচ করেছে। এতো বিশাল বিনিয়োগ ও সময় ব্যয়ের পরেও প্রকল্পটি অদ্যাবধি সম্পূর্ণভাবে আলোর মুখ দেখেনি। এই অস্বাভাবিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং সীমাহীন ব্যয়ের পেছনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের করিডর নির্বাচনের ভুলকে। এই গুরুতর ভুলের জন্য ইতোমধ্যেই দেশের কোষাগার থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়ে গেছে, যা অপচয়কৃত সরকারি অর্থের এক উল্লেখযোগ্য অংশ।
মৌলিক ত্রুটি ও সরকারি সিদ্ধান্ত
অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল প্রকল্পের সামগ্রিক মূল্যায়ন করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এই প্রকল্পের জন্য করিডর সিলেকশন ছিল একেবারেই ভুল। একটি বিআরটি প্রকল্পের জন্য উপযুক্ত ভৌগোলিক ও ট্রাফিক পরিস্থিতি বিবেচনা না করে নেওয়া এই সিদ্ধান্তই আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। ফলস্বরূপ, সরকার বিআরটি প্রকল্পটি বন্ধ করে এটিকে একটি বিশেষায়িত বাস লেনের পরিবর্তে একটি সাধারণ চার লেনের সড়ক হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের পর প্রকল্পের ভবিষ্যত গতিপথ নির্ধারণ এবং এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য দ্রুত একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। একজন স্বনামধন্য যোগাযোগ বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে গঠিত হতে যাওয়া এই কমিটির প্রজ্ঞাপন শিগগিরই জারি করা হবে বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ ও কর্তৃপক্ষের স্বীকারোক্তি
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, ২০.৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটের এই বিআরটি প্রকল্পটি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী এবং জটিলতম প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিআরটি সাধারণত প্রশস্ত ও সমতল সড়কের জন্য ডিজাইন করা হলেও, এই করিডরে একাধিক স্থানে অপ্রয়োজনে ফ্লাইওভার তৈরি করে প্রকল্পের খরচ ও জটিলতা বহুগুণে বাড়ানো হয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত নির্মাণ কৌশলই প্রকল্পের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করে যুগান্তরকে জানান, “গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডরের বিআরটি করার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা বিভিন্ন মূল্যায়নে উঠে এসেছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে সরকার ওই করিডরটি সাধারণ পরিবহণ চলাচলের উপযোগী রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে আর কোনো বিশেষায়িত বাস চলাচল করবে না।”
একই প্রসঙ্গে, সড়ক পরিবহণ, সেতু এবং রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. শেখ মইনউদ্দিন জানান, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি প্রকল্প নিয়ে আর অগ্রসর হবে না। এটি এখন থেকে একটি সাধারণ চার লেনের সড়ক হিসাবে ব্যবহৃত হবে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, এই বিআরটি প্রকল্প নিয়ে বহু বিতর্ক ও অসঙ্গতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে, যার ফলস্বরূপ এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে ওঠেছে। এই ঘটনা দেশের অবকাঠামো প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে আরও সতর্ক ও জবাবদিহিমূলক পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরে।
