আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দলীয় প্রস্তুতি ও কৌশল নির্ধারণের তৎপরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে আরও সুসংহত এবং জনমুখী করতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। এই প্রক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, বরিশাল বিভাগের ২১টি সংসদীয় আসনে দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া বর্তমানে এক চূড়ান্ত ও সংবেদনশীল পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলের রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং দলের জন্য এর কৌশলগত তাৎপর্য বিবেচনা করে, বিএনপি নেতৃত্ব অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রার্থী বাছাইয়ের এই কাজটি সম্পন্ন করছে।
এই ব্যাপক প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, আগামী সোমবার, ২৭ অক্টোবর, বিকাল ৪টায় রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এই বৈঠকে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা সরাসরি অংশ নেবেন। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হলো, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই বৈঠকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যুক্ত থাকবেন। এটি একদিকে যেমন প্রার্থী বাছাইয়ের প্রতি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সরাসরি তদারকির ইঙ্গিত বহন করে, তেমনি এটি দলের আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থারও একটি প্রতিফলন।
মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও প্রার্থী বাছাইয়ের মাপকাঠি
দলীয় নির্ভরযোগ্য সূত্র মারফত জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের ২০টি আসন থেকে মোট ৬০ জন মনোনয়নপ্রত্যাশীকে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বৈঠকের সফল পরিসমাপ্তির পর চলতি মাসের শেষ অথবা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই দক্ষিণাঞ্চলের এই গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে সবুজ সংকেত প্রদান শুরু হবে। এই ঘোষণা দলের তৃণমূল কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক প্রত্যাশা ও উৎসাহ সৃষ্টি করেছে, যা নির্বাচনী প্রস্তুতির গতিকে আরও বেগবান করবে।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে দলের হাইকমান্ড বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট ও কঠোর মাপকাঠি অনুসরণ করছে। সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে, এই বৈঠকে উপস্থিত প্রার্থীদের রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের ভূমিকা, দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে তাদের অবস্থান এবং জনগণের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা হবে। দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও দুর্দিনের কর্মীদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে, যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দলের আদর্শ ও লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকেছেন। এ মূল্যায়নের ভিত্তিতেই প্রাথমিকভাবে প্রার্থীদের চূড়ান্ত করা হবে, যা দলের সামগ্রিক নির্বাচন কৌশলের একটি অপরিহার্য অংশ।
তবে, বরিশাল বিভাগের ২১টি আসনের মধ্যে বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনটি এই প্রাথমিক বৈঠকের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। এই আসনে স্থানীয় পর্যায়ে চলমান বিরোধ এবং মনোনয়ন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে দলের হাইকমান্ড সরাসরি এই বিষয়টি নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি দলের নেতৃত্ব কর্তৃক কোনো ধরনের আপোষ না করে, বিশেষ পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মাধ্যমে সমাধানের পথ বেছে নেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে, যা অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে দলের দৃঢ়তার পরিচায়ক।
নেতৃত্বের বার্তা ও সম্মিলিত লক্ষ্য
এর পূর্বে, গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত একটি ব্যাপক সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় বরিশাল বিভাগের মোট ২১টি আসন থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ মনোনয়নপ্রত্যাশী অংশ নিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে থেকে মাত্র ৫৩ জনকে দ্বিতীয় পর্যায়ের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছিল। বর্তমান বৈঠকে যারা সরাসরি অংশ নিচ্ছেন, তারা মূলত সেই সকল নেতা, যারা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং স্থানীয় পর্যায়ে তাদের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। এটি দলের কৌশলগত সিদ্ধান্ত, যেখানে মাঠের পরীক্ষিত ও জনসম্পৃক্ত নেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান এই প্রক্রিয়াটিকে একটি সুসংগঠিত পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বিএনপির মতো একটি বৃহৎ ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলে প্রতিটি আসনেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন একাধিক নেতা রয়েছেন, যার সংখ্যা গড়ে ৪-৫ জন। তাঁর মতে, “মনোনয়ন চাইলেই যেমন সবাই পাবেন না, তেমনি দলেরও একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে।” তিনি আরও যোগ করেন যে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই বৈঠকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জন্য দিকনির্দেশনামূলক এবং গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করবেন, যা দলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়ক হবে এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে।
আকন কুদ্দুসুর রহমান শুধুমাত্র মনোনয়ন চাওয়া কিংবা সংসদ সদস্য হওয়াকে বড় কথা হিসেবে আখ্যায়িত না করে, ‘ধানের শীষের বিজয়’-কে দলের সকল নেতাকর্মীর একমাত্র ও সম্মিলিত লক্ষ্য হিসেবে জোর দিয়েছেন। এই বার্তা দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং বৃহত্তর দলীয় লক্ষ্যের প্রতি নিবেদনের ওপর আলোকপাত করে। এটি স্পষ্ট করে যে, দলের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকলেও, চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সম্মিলিতভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া, জনগণের ম্যান্ডেট অর্জন করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা।
গুলশান কার্যালয়ের এই বৈঠক শুধু বরিশাল বিভাগের জন্যই নয়, বরং সমগ্র দেশের নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য বিএনপির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন হলে দলের তৃণমূল পর্যায়ে নতুন উদ্যম ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণার মাধ্যমে দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নির্বাচনী যুদ্ধ ঘোষণা করবে, যা আগামী দিনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং দলের ভবিষ্যৎ পথচলায় একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
