মানবজীবনের এক নির্মম পরিহাস! যে ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জীবন থেকে পলায়নের আকুতি জানিয়েছিলেন, নিয়তির নির্মম পরিহাসে ঠিক সেই পলায়নের পথেই তাকে চিরবিদায় নিতে হলো। গত রবিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের নির্মাণাধীন পিলারের বিয়ারিং প্যাড মাথায় পড়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারালেন আবুল কালাম আজাদ। তার শেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখা ছিল, ‘ইচ্ছা তো অনেক, আপাতত যদি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম।’ এই উক্তি যে এত দ্রুত এবং এমন ভয়াবহ উপায়ে তার বাস্তবতায় রূপ নেবে, তা তার প্রিয়জনদের কল্পনারও অতীত ছিল।
এক আকস্মিক দুর্ঘটনা: ফার্মগেটের রাজপথে মর্মান্তিক পরিণতি
ঘটনাটি ঘটে গত রবিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুর নাগাদ, যখন আবুল কালাম আজাদ এক ব্যক্তিগত কাজে রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট এলাকা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই যাত্রাই যে জীবনের শেষ অধ্যায়ে পরিণত হবে, কে জানত? প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, আচমকা মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড অপ্রত্যাশিতভাবে নিচে খসে পড়ে। এই ভারী ধাতব যন্ত্রাংশটি সরাসরি আবুল কালামের মাথায় আঘাত হানলে তিনি গুরুতর জখম হন। ঘটনার আকস্মিকতায় আশেপাশের পথচারীরা হতবাক হয়ে যান এবং দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে, কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন, যা ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকলের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া ফেলে।
স্বপ্ন ও দায়িত্বের জালে বোনা একটি জীবন
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আবুল কালাম আজাদ ছিলেন একজন উদ্যোগী ও কর্তব্যপরায়ণ যুবক। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফলভাবে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার পর রাজধানী ঢাকায় নিজের একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করতেন। জীবিকার তাগিদেই হোক অথবা ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই হোক, ফার্মগেট এলাকা ছিল তাঁর নিত্যদিনের যাতায়াতের পথ। কেবল ব্যবসায়িক নয়, ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজেও তাঁকে প্রায়শই এই এলাকায় আসতে হতো।
পারিবারিক তথ্যমতে, চার ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন আবুল কালাম। তাঁর সংসারে স্ত্রী ও দুটি ছোট্ট সোনামণি— ৫ বছর বয়সী ছেলে আব্দুল্লাহ এবং ৩ বছর বয়সী মেয়ে সুরাইয়া আক্তার— নিয়ে তাঁরা নারায়ণগঞ্জের পাঠানতলি এলাকায় বসবাস করতেন। এই ছোট্ট পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে কেবল একটি জীবনের পরিসমাপ্তিই ঘটেনি, বরং একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন এবং অস্তিত্বও এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
জীবনের শেষ আর্তি: ফেসবুকের পাতায় বিষণ্ণতার ছোঁয়া
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার প্রায় ১৫ ঘণ্টা পূর্বে আবুল কালাম আজাদ তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে একটি হৃদয় বিদারক পোস্ট করেছিলেন। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইচ্ছা তো অনেক, আপাতত যদি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম।’ এই কয়েকটি শব্দ যেন ছিল তাঁর গভীর মানসিক অস্থিরতা এবং জীবনের প্রতি এক চাপা অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। কে জানত, তার এই সরল আর্তি এত দ্রুতই এক ভয়াবহ বাস্তবতায় রূপান্তরিত হবে? এই পোস্টের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি এমন এক করুণ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারালেন।
পরিবারের ওপর নেমে আসা শোকের ছায়া
আবুল কালামের আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর পরিবারে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। তাঁর ভাবি, আছমা আক্তার, অশ্রুসিক্ত নয়নে জানান, “দুপুর প্রায় ১২টার দিকে ওর সাথে আমার শেষ কথা হয়। ও আমাকে বলেছিল, দু-এক দিনের মধ্যে বাড়ি আসবে এবং আমার কাছে ইলিশ মাছ কিনে রাখার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু কে জানত, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই এমন একটি মর্মান্তিক সংবাদ শুনতে হবে?” তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, যা এই শোকাহত পরিবারের অসহায়ত্বকেই যেন আরও প্রকট করে তোলে। এই অপ্রত্যাশিত বিয়োগান্তক ঘটনাটি কেবল আবুল কালামের পরিবারের জন্যই নয়, পুরো সমাজের জন্য এক গভীর বেদনা ও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আধুনিক নগরজীবনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে এসেছে।
