সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি চাঞ্চল্যকর দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছে বাংলাদেশ কারা অধিদপ্তর। এই দাবির মূলে ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েলকে কানাডার টরন্টোতে দেখা যাওয়ার একটি ভিত্তিহীন গুজব। কারা কর্তৃপক্ষ দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছে যে, তিনি বর্তমানে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে আইনগত প্রক্রিয়ার অধীনে অন্তরীণ রয়েছেন এবং গুজবের কোনো সত্যতা নেই।
কারা কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট বিবৃতি
রবিবার (২৬ অক্টোবর) প্রকাশিত একটি বিস্তারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে, কারা কর্তৃপক্ষ জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করতে এই বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “কমান্ডার সোহায়েলকে ঘিরে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার ব্যাপকভাবে ছড়ানো হচ্ছে, যা সর্বৈব মিথ্যা ও বানোয়াট। তিনি বর্তমানে কেরানীগঞ্জ কারাগারে আটক আছেন এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার সম্মুখীন।” জনসাধারণের প্রতি বিভ্রান্তিকর তথ্য বা গুজবে কান না দেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে আহ্বান জানিয়েছে। তারা আরও উল্লেখ করেছে যে, সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত এসব ভিত্তিহীন পোস্টের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই এবং এগুলো কেবল জনমনে অস্থিরতা তৈরির উদ্দেশ্যে ছড়ানো হচ্ছে।
গুজবের সূত্রপাত
উল্লেখযোগ্য যে, এই গুজবের সূত্রপাত ঘটে গত শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট ভাইরাল হওয়ার মাধ্যমে। ওই পোস্টে দাবি করা হয়েছিল যে, রিয়ার অ্যাডমিরাল সোহায়েলকে কানাডার টরন্টো শহরের স্কারবরো এলাকায় প্রত্যক্ষ করা গেছে। দ্রুতই এই দাবি হাজারো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনমনে বিতর্কের জন্ম দেয়, যা কারা কর্তৃপক্ষকে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য করে।
আটক ও বদলির প্রেক্ষাপট
প্রাপ্য তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২০ আগস্ট ঢাকার বনানী এলাকা থেকে মোহাম্মদ সোহায়েলকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক আটক করা হয়। এর মাত্র কিছুদিন পূর্বে, অর্থাৎ ৭ আগস্ট, তাকে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে নৌবাহিনীর ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডারের পদে বদলি করা হয়েছিল। তার এই আকস্মিক পদচ্যুতি এবং পরবর্তী গ্রেপ্তার তৎকালে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, যা তার কর্মজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হয়।
কর্মজীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েল কর্মজীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। এর আগে, তিনি ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে একই বছরের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনের এক পর্যায়ে, ২০১০ সাল থেকে পরবর্তী দুই বছর তিনি বাংলাদেশ র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক হিসেবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন।
গুরুতর অভিযোগ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
তার র্যাব মহাপরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম শাখা) থাকাকালীন সময়ে, তার বিরুদ্ধে নিরীহ ও সাধারণ নাগরিকদের বিনা কারণে আটক করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ রয়েছে যে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন ও প্রভাবশালী কর্মকর্তা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে পুলিশ বা র্যাবের কাছে অভিযোগ দায়ের করার সাহস কেউ দেখাতে পারেনি। তবে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, তার অতীতের এই বিতর্কিত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডগুলো নতুন করে জনসমক্ষে আলোচনার কেন্দ্রে আসে। যদিও সামাজিক মাধ্যমে ৫ আগস্টের পর তার গা ঢাকা দেওয়ার কথা জনশ্রুতিতে আসে, তবে স্মরণ করা প্রয়োজন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে এর বহু পূর্বেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন।
কারা কর্তৃপক্ষের এই বিবৃতি জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যখন গুজব ও ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তখন কর্তৃপক্ষের এমন দ্রুত এবং সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা অত্যন্ত জরুরি। জনসাধারণের প্রতি আবারও আহ্বান জানানো হয়েছে, যেকোনো তথ্য বিশ্বাস করার আগে তার সত্যতা যাচাই করে নেওয়া অত্যাবশ্যক।
