More

    তানজিমের আক্ষেপ, ‘যদি একজন ব্যাটসম্যানও দাঁড়িয়ে যেত’

    ক্রিকেট মানেই অনিশ্চয়তা, জয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও হারের গ্লানি যেমন থাকে, তেমনই থাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে ঘটে যাওয়া তেমনই এক রোমাঞ্চকর টি-২০ ম্যাচে বাংলাদেশ দলের শেষ মুহূর্তের লড়াই দর্শকদের হৃদয়ে এক মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। পরাজয়ের বিষাদ সত্ত্বেও, দলের ভেতরের এক অদম্য স্পিরিট ছিল লক্ষণীয়। তবে ম্যাচের শেষে সব আলোচনা যখন ঘুরেফিরে আসছিল, তখন তানজিম হাসানের কণ্ঠে শোনা যায় এক গভীর আক্ষেপ: ‘ম্যাচটা যদি শেষ করে আসতে পারতাম…’। এই আফসোস শুধু তার একার ছিল না, বরং পুরো দেশ এবং লক্ষ লক্ষ ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়ে অনুরণিত হয়েছে, যারা স্বপ্ন দেখছিলেন এক অবিস্মরণীয় প্রত্যাবর্তনের।

    নাটকীয় পটভূমি: হারানো ম্যাচ থেকে ফিরে আসার স্বপ্ন

    নিঃসন্দেহে, ম্যাচের পরিস্থিতি একসময় এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, জয়ের আশা প্রায় নির্বাপিত হয়ে পড়েছিল। মাত্র ৫৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন ধুঁকছিল পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। এমন কঠিন সময়ে যখন পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী, ঠিক তখনই যেন ঘুরে দাঁড়ানোর এক অপ্রতিরোধ্য স্পৃহা দেখা গেল। শেষ দুই ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৩০ রান। চট্টগ্রামের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটকে বিবেচনায় আনলে, এই লক্ষ্যটি অবিশ্বাস্য মনে হলেও, সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তখন হাতে ছিল মাত্র একটি উইকেট, যা কাজটিকে আরও দুরূহ করে তুলেছিল। এরপরেও, সম্ভাবনার আলো পুরোপুরি নিভে যায়নি, এক সুপ্ত আশা জিইয়ে রেখেছিল দর্শকদের মনে।

    ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’র খেলা: তাসকিনের বিতর্কিত আউট

    ক্রিকেটে ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’ শব্দগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ম্যাচের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যখন শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তা চলছিল, তখন তাসকিন আহমেদ একটি বলে হিট আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। কিন্তু সেই বলটি যে রশির ওপর দিয়ে সীমানার ওপারে চলে গিয়েছিল! যদি তাসকিন আউট না হতেন, তবে সমীকরণটি হয়তো নেমে আসত মাত্র ২ বলে ১১ রানে। কে জানে, সেই মুহূর্তে কী ঘটত! একটি সিঙ্গেল বা একটি বাউন্ডারি হয়তো ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে। এমন ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই টি-২০ ক্রিকেটের সৌন্দর্য এবং নিষ্ঠুরতাকে একইসাথে ফুটিয়ে তোলে, যেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভুলের মাশুল গুণতে হয় পুরো দলকে।

    উপার সারির ব্যর্থতা ও শিশিরের প্রভাব: তানজিমের পর্যবেক্ষণ

    তবে এই কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় দলের উপার সারির ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে তানজিম হাসানও একই কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি স্পষ্টত বলেন, ‘আপনি যদি দেখেন, শেষের দিকে শিশির থাকার কারণে বল অনেক সহজে ব্যাটে আসছিল। আমার কাছে মনে হয়, যদি একটা সেট ব্যাটসম্যান থাকত, তাহলে খেলাটা সহজ হয়ে যেত। কারণ, শেষ দুই ওভারে ৩০ রান লাগলে, একটা সেট ব্যাটসম্যান থাকলে সব সময় এই ম্যাচ হাতের মধ্যে থাকে।’ এই মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, যদি ওপরের সারির কোনো ব্যাটসম্যান উইকেটে টিকে থেকে সেট হতে পারতেন, তাহলে হয়তো ম্যাচের ফলাফল ভিন্ন হতে পারত, কারণ শেষ মুহূর্তে পিচের আচরণ ছিল ব্যাটসম্যানদের অনুকূলে।

    আশার আলো: তানজিম-নাসুমের লড়াকু জুটি

    বাংলাদেশের জন্য ম্যাচটিকে এতদূর টেনে এনেছিলেন মূলত তানজিম হাসান এবং নাসুম আহমেদ। সপ্তম উইকেট জুটিতে এই দুই ব্যাটসম্যান ২৩ বলে ৪০ রানের এক অসাধারণ পার্টনারশিপ গড়েন, যা একসময় প্রায় হারানো ম্যাচে নতুন করে জয়ের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিল। তাদের এই জুটি ছিল এক আশার আলো, যা প্রায় নিভে যাওয়া ম্যাচের প্রদীপে নতুন করে শিখা জ্বালিয়েছিল। যেখানে প্রতিটি রান ছিল মূল্যবান, সেখানে তাদের দৃঢ়তা এবং প্রত্যয়ী ব্যাটিং ছিল সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তারা শুধু স্কোরবোর্ড সচল রাখেননি, বরং দর্শকদের মনে বিশ্বাস জাগিয়েছিলেন যে, অসাধ্য সাধনও সম্ভব।

    জিতিয়ে না পারার বেদনা: তানজিমের অন্তর্দৃষ্টি

    নিজের ২৭ বলে ৩৩ রানের লড়াকু ইনিংসের পরও তানজিমের কণ্ঠে জয় না পাওয়ার এক গভীর আক্ষেপই শোনা গেল। তিনি ম্যাচ কাছাকাছি আনার তৃপ্তি অনুভব করেননি, বরং জেতাতে না পারার ব্যর্থতাই তাকে বেশি পীড়া দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আসলে শেষ করতে পারলে খুব ভালো লাগত। কারণ, আমি পুরো সেট ছিলাম, বল অনেক ভালো ব্যাটে লাগছিল। নাসুম ভাইও আমাকে ভালো সাপোর্ট দিচ্ছিলেন, বাউন্ডারি মারছিলেন। মনে হচ্ছিল আমি একটা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে ব্যাটিং করছি।’ তানজিমের এই উক্তি তার আত্মবিশ্বাস এবং ম্যাচ জেতানোর তীব্র ইচ্ছাকে তুলে ধরে। তিনি অনুভব করছিলেন, তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন এবং নাসুমের সহযোগিতায় তারা শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে পারতেন। এই অনুভূতি হয়তো পরাজয়ের পর যেকোনো লড়াকু ক্রিকেটারের জন্যই স্বাভাবিক, যিনি নিজের সেরাটা দিয়েও দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিতে পারেননি।

    রিশাদ হোসেনের অব্যক্ত আফসোস

    এই ম্যাচের শেষদিকে যখন তানজিম ও নাসুম ব্যাট করছিলেন, তখনো ব্যাট হাতে নামার সুযোগ পাননি রিশাদ হোসেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই, এই কাছাকাছি এসেও ম্যাচ হেরে যাওয়ার পর তার মনেও হয়তো একই ধরনের আফসোস কাজ করেছে – যদি তিনি সুযোগ পেতেন এবং দলের জয়ে অবদান রাখতে পারতেন! হয়তো তার একটি ঝড়ো ইনিংস ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত।

    ভবিষ্যতের শিক্ষা

    শেষ পর্যন্ত ফলাফল বাংলাদেশের পক্ষে না এলেও, এই ম্যাচটি প্রমাণ করে দিল যে, দলের মধ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করার মানসিকতা এখনও বিদ্যমান। তবে বড় ম্যাচ জিততে হলে কেবল লড়াই করলেই চলে না, প্রয়োজন হয় ওপরের সারির ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে আরও দায়িত্বশীল পারফরম্যান্স এবং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে স্নায়ু ধরে রাখার সক্ষমতা। এই পরাজয় হয়তো ভবিষ্যতের জন্য এক মূল্যবান শিক্ষা হয়ে থাকবে, যা দলকে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসতে অনুপ্রাণিত করবে।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here