দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের ঝড় উঠেছে। সম্প্রতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই সুপারিশমালাকে কেন্দ্র করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গঠিত এই কমিশনের সুপারিশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত পোষণকারী পর্যবেক্ষণকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী এবং এটি জনগণের সঙ্গে একটি চরম প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
জাতীয় ঐকমত্য ও ভিন্নমতের গুরুত্ব
জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক এহসান মাহমুদের রচিত ‘বিচার সংস্কার নির্বাচন: অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে তিনি বলেন, কোনো ঐকমত্য প্রক্রিয়ায় যদি ভিন্নমতকে ধারণ করা না হয়, তাহলে সেই ঐকমত্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “যদি ভিন্নমতকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে এই কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?” এই উপেক্ষা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও এক ধরনের প্রতারণার শামিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঐতিহাসিক ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত সুযোগের অপচয়
বিএনপি মহাসচিব তাঁর বক্তব্যে দেশের সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, “এত বড় একটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান, এত আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সুযোগকে জাতির কল্যাণে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, যতই দিন যাচ্ছে, জাতীয় জীবনে বিভাজন রেখা ক্রমশ সুস্পষ্ট হচ্ছে। এই বিভক্তির জন্য কারা দায়ী এবং এর পেছনে কী কারণ রয়েছে, তা গভীরভাবে উপলব্ধি করার আহ্বান জানান তিনি। বিশেষ করে, গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে পুরোপুরি ঘায়েল করার যে প্রচেষ্টা চালায়, তা এই বিভাজনকে আরও তীব্র করছে বলে তিনি মনে করেন।
কমিশনের প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ
গতকাল মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ জমা দিয়েছে, তা নিয়েই মূলত মির্জা ফখরুলের এই তীব্র প্রতিক্রিয়া। তিনি জানান, যে বিষয়গুলোতে তাঁরা একমত হতে পারেননি, সেখানে তাঁরা সুস্পষ্টভাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ জমা দিয়েছিলেন। কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি ছিল যে, এই ভিন্নমতগুলো সুপারিশমালায় লিপিবদ্ধ করা হবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, প্রকাশিত সুপারিশে সেই ভিন্নমতগুলো সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমাদের দ্বিমত পোষণকারী মন্তব্যগুলোকে পুরোপুরি ইগনোর করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই ঐক্য হতে পারে না। তাহলে ঐকমত্য কমিশন গঠনের সার্থকতা কোথায়?” এই প্রশ্ন উত্থাপন করে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভিন্নমতকে পাশ কাটিয়ে কোনো প্রকৃত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, যা শুধু জনগণের আস্থাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এই বক্তব্য দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জকে আবারও সামনে নিয়ে এলো। তাঁর অভিযোগ, কমিশনের এই পদক্ষেপ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেই নয়, বরং দেশের আপামর জনসাধারণের সাথেও এক ধরনের বড় প্রবঞ্চনা, যা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য শুভ বার্তা বহন করে না।
