আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এবং হামলার আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে, তা দেশের রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এমন জনসমক্ষে উদ্বেগের প্রকাশ কেবল ভুল বার্তা দেয় না, বরং সামগ্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব; এই পরিস্থিতিতে তাদের উচিত ভোটারদের মনে আস্থা তৈরি করা, শঙ্কা নয়।
নির্বাচনী শঙ্কা ও সরকারি বক্তব্যের যৌক্তিকতা
নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য হামলা বা চক্রান্তের আশঙ্কা প্রকাশ করার বিষয়টি মোটেই কাম্য নয়। যদি বাস্তবিক অর্থেই কোনো ধরনের চক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে, তবে সরকারের উচিত জনসমক্ষে তা প্রচার না করে বরং সে বিষয়ে যথাযথ গোয়েন্দা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এমন বক্তব্য সাধারণ জনগণের মধ্যে অনর্থক ভীতির সঞ্চার করে এবং নির্বাচনী পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে। রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো, নির্বাচনকেন্দ্রিক যেকোনো ঝুঁকি মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ভোটারদের মধ্যে সম্পূর্ণ আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলা। সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে যেন একটি স্বচ্ছ ও প্রশ্নাতীত নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকে।
আস্থা সংকট ও নেতিবাচক প্রভাব
দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার পর হঠাৎ করে ‘আক্রমণের আশঙ্কা’র মতো বক্তব্য দেওয়া হলে তা সাধারণ মানুষের মনে গভীর ভীতির সঞ্চার করে। এই ধরনের বিবৃতি সমাজে একটি অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি কেবল ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিতই করে না, বরং যারা নির্বাচনে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের জন্য একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, জনমনে আস্থার পরিবর্তে শঙ্কার বীজ রোপিত হয়, যা একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।
প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা ও প্রত্যাশা
জাতির কাছে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে প্রত্যাশা থাকে ভিন্ন। জাতি তাঁর কাছ থেকে এমন বক্তব্য আশা করে, যা সব বাধা অতিক্রম করে একটি সফল নির্বাচন আয়োজনে জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে। তাঁর উচিত হবে নির্বাচনে বিদ্যমান বা সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ভোটারদের মনে অটল আস্থা ফিরিয়ে আনা। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাঁকে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এই সংকটময় মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি।
রাজনৈতিক ঐক্যের অপরিহার্যতা
নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার আরও শক্তিশালী ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করা উচিত। এটা সত্য যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ে মতানৈক্য থাকা স্বাভাবিক। তবে, একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের মতো মৌলিক বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে একমত হওয়া অপরিহার্য। প্রধান উপদেষ্টার উচিত এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে দলগুলো নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে যেন কোনো পক্ষই নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংকট তৈরি করতে না পারে, এবং এই বিষয়ে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
অযৌক্তিক এজেন্ডা ও সময়ক্ষেপণ
অনেকেই মনে করেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এতগুলো নতুন এজেন্ডা নিয়ে আসা অযৌক্তিক এবং এতে কেবল সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব মতাদর্শ ও নীতি নিয়ে পরিচালিত হয়; সুতরাং, সব বিষয়ে তাদের মধ্যে পূর্ণ ঐকমত্য আশা করা বাস্তবিক নয়। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে চলা দলগুলোর কাছ থেকে প্রতিটি বিষয়ে একমত হওয়ার প্রত্যাশা করাটা অবাস্তব। বরং, নির্বাচনকে এগিয়ে আনলে এই ধরনের জটিলতা এবং ঝামেলা অনেকটাই কমিয়ে আনা যেত বলে অনেকে মনে করেন। এতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া আরও সরল ও মসৃণ হতে পারত।
ন্যূনতম ঐকমত্যে সরকারের গাফিলতি
একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য ন্যূনতম কিছু জায়গায় ঐকমত্য তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এক ধরনের গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়েছে। পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ সমঝোতা তৈরির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। এই গাফিলতি নির্বাচনের পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং এর ফলস্বরূপ বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একটি সফল নির্বাচনের জন্য এই ন্যূনতম ঐকমত্যের গুরুত্বকে কোনোভাবেই খাটো করা যায় না।
