সাম্প্রতিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐক্য ও সংহতির পরিবর্তে বিভেদের সুর প্রকট হয়ে উঠেছে বলে পর্যবেক্ষণ করেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তাঁর মতে, এই অস্থির সময়ে জাতীয় ঐকমত্যের বদলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য গভীর সংকটের জন্ম দিচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
রাজনৈতিক বিভেদ উসকে দেওয়ার অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে
পাটওয়ারী দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেন যে, দেশের রাজনৈতিক বিভাজন ও অনৈক্য সৃষ্টির পেছনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি ভবিষ্যতের ইতিহাসে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বিভেদ উসকে দেওয়ার জন্য কোনো দলের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়, তবে তা হবে বিএনপি। এই প্রবণতাকে তিনি ‘অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং অবিলম্বে বিএনপিকে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক ও বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতি থেকে সরে আসার জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর মতে, এই ধরনের রাজনীতি কেবল দেশকে পঙ্গু করে দিতে পারে, জনস্বার্থে কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী উপরোক্ত মন্তব্যগুলো করেন। ‘জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং জাতীয় নির্বাচন কোন পথে’ শীর্ষক এই সেমিনারটির আয়োজন করে জাতীয় যুবশক্তি, যা এনসিপির একটি সক্রিয় যুব সংগঠন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে আলোচনার জন্যই এই সেমিনারটির আয়োজন করা হয়েছিল।
জাতীয় সংকট ও রাজনৈতিক দর-কষাকষির অভিযোগ
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, জামায়াত ইসলামী ‘পিআর’ (Proportional Representation) পদ্ধতিতে নিম্নকক্ষের আসন বণ্টন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, অন্যদিকে বিএনপি উত্থাপন করেছে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমতের প্রসঙ্গ। তাঁর অভিযোগ, এই দলগুলো মূলত এই ইস্যুগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দর-কষাকষিতে লিপ্ত হতে চাইছে—বিশেষত ডিসি এবং এসপি-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিজেদের পছন্দের লোকবল নিয়োগের উদ্দেশ্যে। পাটওয়ারী গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যখন জাতি এক সুদূরপ্রসারী সংকটের মুখোমুখি, তখন এই দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দেশকে আরও একটি নতুন ও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং অগ্রহণযোগ্য।
গণভোটের গুরুত্ব ও জামায়াতের প্রতি আহ্বান
প্রস্তাবিত গণভোটের প্রসঙ্গ টেনে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জোর দিয়ে বলেন যে, যদি ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়যুক্ত হয়, তবে তা কোনো বিশেষ দলের নয়, বরং এটি হবে বাংলাদেশের আপামর জনগণের বিজয়। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, এই বিজয় কোনোভাবেই জামায়াতে ইসলামী-এর বিজয় হিসেবে গণ্য হবে না, কারণ এটি একটি বৃহত্তর জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জামায়াতে ইসলামী-এর প্রতি আহ্বান জানান তাদের ‘ভণ্ডামি’ পরিহার করে স্বচ্ছ ও সৎ পথে আসার জন্য। পাটওয়ারী তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনারা ভণ্ডামি বাদ দিন এবং আপনাদের অন্তরে আসলে কী আছে, তা জাতির সামনে উন্মোচন করুন। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আপনাদের প্রকৃত অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত।’
অসুস্থ রাজনীতি পরিহারের জোরালো আহ্বান
এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী তার বক্তব্যে বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি স্পষ্ট করেন যে, জাতীয় সংকটের মুহূর্তে এমন বিভাজনমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক কৌশল কেবল জাতিকে আরও গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। পাটওয়ারী পুনরায় সব রাজনৈতিক দলকে ‘অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা’ পরিহার করে জাতীয় স্বার্থে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান। তার মতে, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঐক্য ও পারস্পরিক বোঝাপড়া অপরিহার্য, যা যেকোনো প্রকার দলীয় ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান পাওয়া উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জাতীয় ঐকমত্যই একমাত্র পথ বলে তিনি জোর দেন।
