চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরদের হাতে তুলে দেওয়া এবং বন্দর সেবার মাশুল অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই দুটি প্রধান ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন মহলের সিদ্ধান্ত এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়িক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। চলুন, এই বিতর্কের মূল প্রেক্ষাপট, এর সূত্রপাত এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আপত্তির বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
বিতর্কের সূত্রপাত: প্রেক্ষাপট ও মূল কারণ
চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের বিষয়টি নতুন নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যদিও তখন এটি বড় ধরনের কোনো বিতর্কের জন্ম দেয়নি। তবে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায় যখন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। বন্দর ব্যবহারকারী এবং সংশ্লিষ্ট মহলের মধ্যে একটি সুদৃঢ় ধারণা ছিল যে, নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ আমলের বিদেশি অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসবে। বিশেষত, অত্যন্ত সফলভাবে পরিচালিত নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (NCT)-কে বিদেশিদের হাতে হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্তই নেওয়া হবে বলে ব্যাপক প্রত্যাশা ছিল।
তবে, এসব প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারই এই টার্মিনালটি সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে দীর্ঘমেয়াদে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়। এই পদক্ষেপটিই বিতর্কের মূল কেন্দ্রে চলে আসে। আলোচনার সূত্রপাত আরও জোরালো হয় যখন সরকার কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই জি টু জি (সরকার–সরকার) পদ্ধতির মাধ্যমে এই চুক্তি এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এতে স্বচ্ছতার অভাব এবং দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়।
নিউমুরিং টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের এই প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকেই প্রতিবাদ শুরু হয়। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের বন্দর শাখা প্রথমে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের আপত্তি জানায়। এরপর, দেশের বাম গণতান্ত্রিক জোটও এই ইস্যুতে সরব হয়ে ওঠে এবং বিষয়টি জাতীয় রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
মাশুল বৃদ্ধি: ব্যবসায়ীদের আপত্তি ও প্রতিক্রিয়া
বিদেশি অপারেটর নিয়োগ সংক্রান্ত বিতর্ক যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নতুন ট্যারিফ নির্ধারণ করে। ব্যবসায়িক মহলের তীব্র আপত্তি ও উদ্বেগ সত্ত্বেও, গত ১৪ সেপ্টেম্বর বন্দর সেবার মাশুল একলাফে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি করার ঘোষণা দেওয়া হয়, যা ছিল একটি অপ্রত্যাশিত এবং অত্যধিক বৃদ্ধি। এই বর্ধিত মাশুল এক মাস পর, অর্থাৎ ১৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়। বন্দর ব্যবহারকারীদের উপর এই আকস্মিক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরাও আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন।
মাশুল বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রথম ও প্রধান আপত্তি আসে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছ থেকে। ‘চট্টগ্রামের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীবৃন্দ’ নামক একটি ব্যানারে গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের র্যাডিসন ব্লু হোটেলে আয়োজিত এক সভায় তীব্র অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এই সভায় ব্যবসায়ীরা স্পষ্ট করে বলেন যে, বিদেশি অপারেটরদের অনৈতিক সুবিধা প্রদান এবং তাদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতেই এই অস্বাভাবিক মাশুল বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাদের মতে, এটি দেশীয় ব্যবসায়ীদের উপর এক অযৌক্তিক বোঝা চাপানোর নামান্তর।
এই প্রতিবাদ আরও জোরালো হয় যখন ২১ অক্টোবর ব্যবসায়ীরা ‘চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরাম’-এর ব্যানারে একটি বৃহৎ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সমাবেশ থেকে তারা মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল এবং বন্দর পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানান। এই ধারাবাহিক প্রতিবাদ এবং আপত্তির ফলে পুরো বিষয়টি এখন দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক পরিবেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
