More

    চোখে না দেখেও যেভাবে খেলেন ব্যাটসম্যানরা

    আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দ্রুতগতির মঞ্চে, প্রতিটি বলই যেন এক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে ব্যাটসম্যানের সামনে। কোন বল খেলবেন, কোনটি ছেড়ে দেবেন, কিংবা খেললেও ঠিক কিভাবে মোকাবিলা করবেন – এই সিদ্ধান্তগুলো নিতে হয় চোখের পলকে। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, বলটিকে ভালোভাবে দেখেই হয়তো এই জটিল সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া সম্ভব। কিন্তু আসলেই কি আন্তর্জাতিক মানের দ্রুতগতির বলকে এত অল্প সময়ে দেখে সঠিক শট খেলা সম্ভব? নাকি বছরের পর বছর অনুশীলন করতে করতে ব্যাটসম্যানরা এক ধরণের অনুমান বা সহজাত প্রবৃত্তি দিয়েই বলের লাইন-লেংথ বিচার করে ফেলেন?

    এই চিরন্তন প্রশ্নের গভীরতর উত্তর নিয়ে এসেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত ক্রিকেট সাংবাদিক ও লেখক জ্যারড কিম্বার তার বহুল আলোচিত বই ‘দ্য আর্ট অব ব্যাটিং’-এ। বিশেষত, বইটির ‘আইজ’ (Eyes) নামক অধ্যায়ে তিনি ব্যাটম্যানদের দৃষ্টিশক্তির পেছনের মনস্তত্ত্ব এবং দক্ষতার রহস্য উন্মোচন করেছেন। কিম্বার দেখিয়েছেন যে, একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যাটসম্যানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কেবল দৃশ্যমান তথ্যের ওপর নির্ভর করে না, বরং এর পেছনে কাজ করে গভীর পর্যবেক্ষণ, পূর্বানুমান এবং এক ধরণের উন্নত উপলব্ধি শক্তি।

    ভালো ব্যাটসম্যানরা যেনো অন্ধকারেও দেখতে পান

    ক্রিকেটের পরিভাষায় ‘অন্ধকারে দেখা’ বলতে আক্ষরিক অর্থে আলোহীন পরিবেশে দেখা বোঝায় না, বরং প্রতিকূল বা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতেও বলের গতিবিধি নির্ভুলভাবে অনুধাবন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাকে নির্দেশ করে। একজন ভালো ব্যাটসম্যানের মস্তিষ্ক এবং চোখ এমন এক সূক্ষ্ম সমন্বয়ে কাজ করে, যা তাদের বলের আগমনপথ, সুইং, সিম বা উচ্চতা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। এই ক্ষমতা কেবল শারীরিক দক্ষতা নয়, বরং এক ধরণের মানসিক তীক্ষ্ণতা এবং বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা অভিজ্ঞতা ও সহজাত প্রজ্ঞার ফল। এটি এমন একটি গুণ, যা তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে এবং ব্যাট-বলের কঠিন লড়াইয়ে এক ধাপ এগিয়ে রাখে।

    পাকিস্তানের কিংবদন্তি ওপেনার সাঈদ আনোয়ার, যিনি নব্বই দশকের অন্যতম সেরা এবং দৃষ্টিনন্দন ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত, তার জীবনে একবার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সাধারণত, তার মতো একজন বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে এমনটা সচরাচর ঘটে না। সেদিন বলের গতি মন্থর হলেও, তার হাত থেকে বের হওয়ার পর বলটিকে যেন সম্পূর্ণভাবে দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, কোনো অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা বলটিকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনুসরণ করতে বাধা দিচ্ছে – যা তাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল। ক্যারিয়ারের দীর্ঘ এগারো বছরে অসংখ্য চড়াই-উতরাই ও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আনোয়ারের জন্য এটি ছিল এক অভূতপূর্ব অনুভূতি, যা তার আত্মবিশ্বাসকেও ক্ষণিকের জন্য দোলা দিয়েছিল।

    আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার মতো একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্রিকেটারের জন্য বল ঠিকমতো না দেখাটা মোটেই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। টেস্ট ক্রিকেটে ওপেনার হিসেবে তার গড় ছিল পঞ্চাশের উপরে – যা তার নিরন্তর ধারাবাহিকতা ও উচ্চ মানের এক অকাট্য সাক্ষ্য। এগারো বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে, যদিও তিনি ৫৫টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন, যেখানে ৪৫.৫০ গড়ে ৪ হাজারেরও বেশি রান সংগ্রহ করেছেন। এই পরিসংখ্যান একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে তার অসামান্য দক্ষতার জীবন্ত প্রমাণ। তবে, তার ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল কিছুটা হতাশাজনক; অভিষেক টেস্টে ‘পেয়ার’ (দুই ইনিংসেই শূন্য রান) মেরে তিনি প্রায় তিন বছর জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন। যদি সেই বিরতি না থাকত এবং তিনি তার প্রতিভার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে আরও বেশি ম্যাচ খেলতে পারতেন, তাহলে তার ম্যাচ সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বাড়তো এবং হয়তো তাকে সর্বকালের সেরাদের কাতারে ফেলা যেত। নব্বই দশকে ২ হাজার বা তার বেশি রান করা ওপেনারদের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা গড় থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান অনেক টেস্ট ম্যাচ তাকে ছাড়াই খেলেছে, যা তার প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়নের অভাবকেই নির্দেশ করে। তার ব্যাট থেকে আরও বহু অসাধারণ ইনিংস দেখার সুযোগ থেকে ক্রিকেটপ্রেমীরা বঞ্চিত হয়েছিল, যা আজও ক্রিকেট বিশ্লেষকদের কাছে এক আলোচনার বিষয়।

    একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যানের সত্যিকারের মান যাচাইয়ের অন্যতম কঠিন মানদণ্ড হলো ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে তাদের পারফরম্যান্স। এই দেশগুলোর উইকেট সাধারণত গতি, সুইং এবং সিমে পরিপূর্ণ থাকে, বিশেষ করে নতুন বলের ক্ষেত্রে। মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া, ঠান্ডা কন্ডিশন এবং সবুজ পিচ প্রায়শই ব্যাটসম্যানদের জন্য দুঃস্বপ্নের কারণ হয়, যেখানে বলের নড়াচড়া এতটাই অপ্রত্যাশিত হতে পারে যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব মনে হয়। সাঈদ আনোয়ার, এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সফল ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তার পরিসংখ্যান থেকে; এই তিন দেশে তার সামগ্রিক গড় ছিল ৪২। এই গড় তার শ্রেণীরই একটি ইঙ্গিত, যেখানে অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানও কঠিন সময় পার করেন এবং মুখ থুবড়ে পড়েন। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেও, যেখানে পেসাররা বরাবরই তাদের বাউন্স এবং গতি দিয়ে দাপট দেখিয়ে থাকেন, মাত্র তিনটি টেস্ট ম্যাচে তিনি একটি দুর্দান্ত সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন, যা বড় মঞ্চে তার পারফর্ম করার সক্ষমতারই পরিচায়ক। এই পরিসংখ্যানগুলো কেবল তার রান সংখ্যার বিচার নয়, বরং চাপের মুখে তার মানসিক দৃঢ়তা, যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা এবং প্রতিপক্ষকে শাসন করার মানসিকতারও প্রতিচ্ছবি।

    Recent Articles

    Related Stories

    Leave A Reply

    Please enter your comment!
    Please enter your name here