যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে এসেছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন, যেখানে ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন বিষয়ক আইন প্রয়োগে এক কঠোর ও আপোষহীন অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিগত নয় মাসে দেশটি প্রায় ৮০ হাজার নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা বাতিল করেছে, যা বিশ্বজুড়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, বাতিলকৃত ভিসাগুলোর মধ্যে অনেকেই ছিলেন বৈধ স্বল্পমেয়াদী অনুমতিপত্রধারী, যাদের ভিসা নানা অপরাধ ও গুরুতর নিয়মভঙ্গের অভিযোগে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির কঠোরতা ও আইন প্রয়োগের দৃঢ়তার এক স্পষ্ট বার্তা বহন করে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২০ জানুয়ারি দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে এক কড়া মনোভাব প্রদর্শন করে আসছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোর অন্যতম ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অবৈধ অভিবাসীমুক্ত’ করার প্রতিশ্রুতি। ক্ষমতায় এসেই তিনি সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তৎপর হন এবং ত্বরিত গতিতে একাধিক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। এই নির্বাহী আদেশগুলির ফলস্বরূপ, প্রথমে ওয়াশিংটন ডিসিতে এবং পরবর্তীতে সমগ্র দেশজুড়ে ব্যাপক অভিযান পরিচালিত হয়। এসব অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী, কাস্টমস ও সীমান্ত সুরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তা এবং আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ফলস্বরূপ, হাজার হাজার নথিপত্রহীন অভিবাসীকে আটক করা হয় এবং তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা অভিবাসন ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
এই তথ্যটি রয়টার্স সংবাদ সংস্থাকে নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। উল্লিখিত ৮০ হাজার ভিসা বাতিলের পরিসংখ্যানে কেবলমাত্র নথিপত্রহীন বা অবৈধ অভিবাসীরাই অন্তর্ভুক্ত নন, বরং একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি ছিলেন যারা বৈধ স্বল্পমেয়াদী ভিসার অধিকারী। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, শুধুমাত্র বেআইনিভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তিরাই নন, বরং যারা বৈধ অনুমতিপত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন, তাদেরকেও কঠোর আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
ভিসা বাতিলের প্রধান কারণসমূহ: অপরাধ ও নিয়মভঙ্গ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই বাতিলকৃত ভিসাধারীদের মধ্যে অপরাধের সুস্পষ্ট বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষত, ১৬ হাজার ব্যক্তির ভিসা বাতিল করা হয়েছে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর (DUI) গুরুতর অপরাধে। একইভাবে, ১২ হাজার জনের ভিসা প্রত্যাহার করা হয়েছে আক্রমণ বা সহিংসতার মতো গুরুতর অভিযোগে, এবং ৮ হাজার জনের ভিসা বাতিল হয়েছে চুরির মতো অপরাধের কারণে। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, উল্লিখিত এই সকল ব্যক্তিই ভিসা বাতিলের পূর্বে বৈধ স্বল্পমেয়াদী ভিসার অধিকারী ছিলেন। রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান যে, যাদের ভিসা বাতিল হয়েছে, তাদের প্রায় অর্ধেকই এই তিন প্রকারের গুরুতর অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এটি স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে, বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
শিক্ষার্থী ভিসায় কঠোরতা: মেয়াদোত্তীর্ণ ও সন্ত্রাসবাদে সমর্থনের অভিযোগ
এই কঠোর নীতির প্রতিফলন দেখা গেছে শিক্ষার্থী ভিসার ক্ষেত্রেও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রের ভাষ্যমতে, গত আগস্ট মাসে প্রায় ৬ হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কেবল ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করার অভিযোগই ছিল না, বরং বিভিন্ন আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি ‘সন্ত্রাসবাদে সমর্থন’ দেওয়ার মতো অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছিল। এই ঘটনা এটিই প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ এখন আর শুধু আইন ভঙ্গকারী বা নথিবিহীন অভিবাসীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছে না, বরং বৈধ ভিসা নিয়ে অবস্থানকারীদের প্রতিও তাদের নজর আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে। এমনকি ‘সন্ত্রাসবাদে সমর্থন’ এর মতো স্পর্শকাতর অভিযোগের ক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতা নীতি (Zero Tolerance Policy) অবলম্বন করা হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে, ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অভিবাসী ও নন-ইমিগ্র্যান্ট উভয়ের জন্যই এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। অবৈধ অভিবাসন রোধ এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত এই কঠোর পদক্ষেপসমূহ দেশটিতে প্রবেশ এবং অবস্থানের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বা আইনভঙ্গ করে, তবে তার ভিসা বাতিলের মতো কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে – এই বার্তাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
