বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির যে জয়যাত্রা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তার মূলে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এটি শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং মানব ইতিহাসের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী দশকে এআই বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করবে, যা এর অভাবনীয় প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। মার্কিন বিশ্লেষকদের মতে, যেখানে ২০২৩ সালে এআই বাজারের আকার ছিল প্রায় ১৫০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে তা বিশাল পরিসরে বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৩৪৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। এই অভাবনীয় প্রবৃদ্ধি এআইয়ের সর্বব্যাপী বিস্তার এবং এর মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনারই প্রমাণ।
এআইয়ের এই দ্রুত বিস্তার ইতিমধ্যেই শিল্প খাতগুলোতে স্পষ্ট। আইবিএমের ২০২৩ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের ৪২ শতাংশ বড় প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাত্যহিক কার্যক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ইতিমধ্যেই সংযুক্ত করেছে। এর বাইরে আরও প্রায় ৪০ শতাংশ সংস্থা এই যুগান্তকারী প্রযুক্তিকে তাদের কর্মপরিবেশে প্রয়োগের সক্রিয় পরিকল্পনা করছে। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, খরচ কমানো এবং নতুন উদ্ভাবনের জন্য এআইকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে।
এই প্রযুক্তি গ্রহণের ঢেউ এখন জেনারেটিভ এআইয়ের ক্ষেত্রেও প্রবল বেগে প্রবাহিত হচ্ছে। জেনারেটিভ এআই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক বিশেষ শাখা, যা নির্দিষ্ট নির্দেশনার ভিত্তিতে জেনারেটিভ মডেল ব্যবহার করে নতুন পাঠ্য, ছবি, ভিডিও বা অন্যান্য ডেটা তৈরি করতে সক্ষম। এর অনন্য সৃজনশীল ক্ষমতার কারণে বর্তমানে প্রায় ৩৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের অংশ হিসেবে এই জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করছে। এটি বিপণন থেকে শুরু করে ডিজাইন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং কন্টেন্ট তৈরিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, যা মানব সৃজনশীলতাকে আরও উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট কর্মীর প্রায় ৪৯ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি কাজে কোনো না কোনোভাবে এআই জড়িত থাকবে। এই ব্যাপক একীভূতকরণ কর্মপরিবেশ এবং মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের ধরনকে আমূল পরিবর্তন করে দেবে। এর ফলে মানুষের কাজের প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসবে, নতুন দক্ষতার চাহিদা তৈরি হবে এবং মানব-এআই সহযোগিতার নতুন মডেল বিকশিত হবে। এটি কর্মক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অগণিত সুযোগও সৃষ্টি করবে, যেখানে মানব মেধা এবং এআইয়ের ক্ষমতা সম্মিলিতভাবে নতুন উদ্ভাবন ঘটাবে।
২০৩০ সালে এআইয়ের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস
এই দশকের শেষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা ঠিক কোথায় পৌঁছাবে? প্রযুক্তিবিদদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যেই এআই এমন কিছু যুগান্তকারী উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যাবে, যা বর্তমান ব্যবস্থার পরিধিকে বহুলাংশে ছাড়িয়ে যাবে। এই অগ্রগতি শুধুমাত্র বিদ্যমান এআই ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করবে না, বরং শিল্প খাতজুড়ে এক মৌলিক পরিবর্তন আনবে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও কাজের পদ্ধতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: শতগুণ দ্রুত কর্মক্ষমতা অর্জন করবে
ভবিষ্যতের এআইয়ের অগ্রগতিতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ভূমিকা হবে অপরিসীম। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলি তাদের কর্মক্ষমতায় বর্তমানের সুপারকম্পিউটারগুলির চেয়ে শতগুণ দ্রুতগতি অর্জন করবে। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য জটিল ডেটা বিশ্লেষণ, প্যাটার্ন শনাক্তকরণ এবং নতুন অ্যালগরিদম তৈরিতে বিপ্লব আনবে। কোয়ান্টাম এআই এমন সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা রাখবে যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারগুলির পক্ষে সম্ভব নয়, যেমন নতুন ওষুধ আবিষ্কার, জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মডেলিং, বা আবহাওয়ার পূর্বাভাসে নির্ভুলতা বৃদ্ধি। এই যুগান্তকারী প্রযুক্তি এআইকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করবে, যেখানে এটি আরও বুদ্ধিমান, আরও স্বায়ত্তশাসিত এবং আরও সক্ষম হয়ে উঠবে, যা মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে।
